প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বাগড়া

প্রথম আলো মহিউদ্দিন আহমদ প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:১৯

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক দিন ধরেই নির্বাচনের জন্য তৈরি হচ্ছিল। কোন দল কাকে কোন আসনে মনোনয়ন দেবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থীতালিকা প্রায় ঠিক করে এনেছে। একটা ভালো নির্বাচন হবে, নাগরিকেরা অবাধে ভোট দিতে পারবেন, নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি শান্ত থাকবে—এটাই সবার চাওয়া। আগের নির্বাচন কমিশনগুলোর অনেক দুর্নাম ছিল। নতুন নির্বাচন কমিশন সেসব কাটিয়ে উঠে নির্বাচনের প্রতি নাগরিকদের হারানো আস্থা আবার ফিরিয়ে আনবে বলে সবার আশা।


নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। আসলেই কি স্বাধীন? যদি তা–ই হয়ে থেকে, তাহলে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা কমিশনের থাকা উচিত। আমরা আগে দেখেছি, কাগজে-কলমে কমিশনকে যতই স্বাধীনতা দেওয়া হোক না কেন, সেখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের আনুগত্য কমিশনের প্রতি, নাকি সরকারের প্রতি, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কমিশনে একজন প্রধানসহ যে ছয়জন আছেন, তাঁরা সবাই সরকারি চাকুরে ছিলেন। কেউ সচিবালয়ে, কেউ বিচার বিভাগে, কেউ সামরিক বাহিনীতে। সরকারের কাজকর্ম যেমন নানা বিধিবিধানের জালে বাধা পড়ে থাকে এবং সরকারি চাকরি করাকালে ওপরওয়ালার হুকুম তামিলের যে অভ্যাস গড়ে ওঠে, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে তাঁরা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারেন, সেটি দেখার বিষয়।


সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকাকালে তাঁরা সব সময় দেখতেন, কাগজে কী সব নিয়ম লেখা আছে। সেখানে পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। কোনো বিষয়ে একটা জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হলে প্রায়ই একটা অজুহাত শোনা যায়, এটা তো নিয়মে নেই। তো সেই নিয়ম পাল্টাতে হলে নতুন আইন লাগে, সংসদে সেটা পাস হতে হয়। তারপর গেজেট হয়। তত দিনে প্রয়োজনটা হয়তো ফুরিয়ে যায় কিংবা বড্ড দেরি হয়ে যায়। সম্প্রতি একটা বিষয় নজর কেড়েছে।


নির্বাচনে মার্কা বা প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে আসছে শত বছর ধরে। নিরক্ষর মানুষ ব্যালটে নাম পড়ে সিল দিতে পারেন না। প্রার্থীকে চিনতে হলে তাঁর মার্কা চিনতে হয়। সে জন্য মার্কা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেক দিন ধরে ফলাও করে বলে আসছি যে সামাজিক নানা সূচকে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। দেশে সাক্ষরতার হার অনেক বেড়েছে। বাস্তবের ছবিটা ভিন্ন। এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষ লিখতে ও পড়তে পারেন না। অনেকেই আছেন, শুধু নাম সই করা মুখস্থ করেছেন। আমরা এত দিন তাঁদের ধরেই সাক্ষরতার হার ঘোষণা করে এসেছি। এ ‘সাফল্য’ দেখিয়ে আমাদের নেতা–নেত্রীরা বিদেশ থেকে অনেক পুরস্কার আর সনদ নিয়ে এসেছেন। তাঁরা যতবার বাইরে যান, একটা করে পুরস্কার নিয়ে আসেন। এটা একটা বড় ধরনের প্রতারণা।


দল ও ব্যক্তির কাছে নির্বাচনী প্রতীক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রতীক যত বেশি পরিচিত, জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত, সেই প্রতীকের চাহিদা তত বেশি। এ কারণেই চাঁদ, তারা, সূর্য, নৌকা, লাঙ্গল, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লার এত চাহিদা।


একবার একটি দলকে কোনো প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হলে পরের নির্বাচনগুলোতে সেই প্রতীকের ব্যাপারে ওই দলের অগ্রাধিকার থাকে। দলের চাওয়া অনুযায়ী যদি প্রতীক বরাদ্দ না করা হয়, তাহলে সেটি দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। মনে আছে, তিয়াত্তরের নির্বাচনের সময় জাসদ প্রথম পছন্দ হিসেবে নৌকা প্রতীক চেয়েছিল। নির্বাচন কমিশন সেটি আমলে নেয়নি। নৌকা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনের যুক্তি ছিল, যেহেতু আওয়ামী লীগ এই প্রতীকে আগেও নির্বাচন করেছে, সুতরাং এটি তাদের প্রাপ্য। জাসদ এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে হেরে গিয়েছিল। পরে জাসদ মশাল প্রতীক পায়।


১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। প্রতীক ছিল দাঁড়িপাল্লা। নির্বাচন কমিশন প্রথমে এই প্রতীক বরাদ্দ দিতে চায়নি। কমিশনের যুক্তি ছিল, দাঁড়িপাল্লা যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের লোগো, সুতরাং এই প্রতীক কোনো রাজনৈতিক দলকে দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এ নিয়ে জামায়াত নেতারা কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁরা এই প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। এটি তাঁদের পরিচিতি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কমিশন জামায়াতের আবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের জন্য দাঁড়িপাল্লা বহাল রাখে।


আমাদের দেশের রাজনীতির আকাশে একটি নতুন তারা হিসেবে মিটমিট করে জ্বলছে এনসিপি নামের একটি দল। বয়স এক বছরও হয়নি। চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এই দল তৈরি করেছেন। দলটি নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে শাপলা চেয়েছে। আরেকটি দল, নাগরিক ঐক্যও শাপলা চেয়েছিল। কমিশন তাদের কাউকে এই প্রতীক দেয়নি। নাগরিক ঐক্য পেয়েছে কেটলি। এটি নিয়ে তারা মোটামুটি খুশি। কমিশনের সঙ্গে তারা বিবাদে জড়ায়নি।
কিন্তু এনসিপি শাপলা পেতে মরিয়া। তারা আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। বলেছে, এ প্রতীক ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচন কমিশন বলছে, যেহেতু কমিশনের তালিকায় শাপলা নেই, এটি বিধিতে নেই। তাই এটি দেওয়া যাবে না। এটা একটা খোঁড়া অজুহাত মনে হয়। তালিকায় না থাকলে তালিকা কি পরিমার্জন করা যায় না? এটা কি আসমানি কিতাব যে বদলানো যাবে না? কোন দল কোন প্রতীকে নির্বাচন করবে, সেটি তাদের ব্যাপার। কমিশন তো এখানে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না! অথচ কমিশন বলছে, অন্য কোনো প্রতীক না নিলে কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এনসিপির জন্য একটি প্রতীক বরাদ্দ করবে। মনে হচ্ছে, কমিশন গায়ের জোরে কথা বলছে। শেষ মুহূর্তে ইসি তালিকায় ‘শাপলা কলি’ প্রতীক যুক্ত করেছে। কিন্তু শাপলা আর শাপলাকলি তো এক জিনিস নয়। ইসি তার গোঁয়ার্তুমিই বজায় রাখল।


কমিশন সম্ভবত ভুলে গেছে তার ভূমিকা। কমিশন হলো নির্বাচনের রেফারি। একটা খেলায় কোন দল কী রকম জার্সি পরবে, সেটি তো রেফারি ঠিক করে দিতে পারে না! দুই দলের জার্সি এক রকম হলে দুই দলের কাপ্তানরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটা আপস করেন। পাকিস্তান আমলে দেখেছি, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের একই রকম জার্সি—সাদা–কালো। তো খেলার দিন তারা নিজেরাই অন্য রঙের জার্সি পরে আসত।
কমিশনের আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ ধারার এক উপধারায় সংশোধন এনে বলা হয়েছে, যদি কোনো রাজনৈতিক দল জোটভুক্ত হয়, তবে সেই নিবন্ধিত দল নিজস্ব প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য থাকবে। আগে এ বিধানে নিজস্ব প্রতীক বা জোটের প্রতীক—দুটোর মধ্যে যেকোনোটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল দলগুলোর।


প্রতীকসংক্রান্ত সংশোধনীটির সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। প্রতীকসংক্রান্ত বিধান অপরিবর্তিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বলছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো যদি জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তারা যেন নিজেদের প্রতীক বা জোটের অন্য কোনো প্রতীক ব্যবহার করার স্বাধীনতা পায়—এই বিধানটাই বহাল থাকা উচিত।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও