আমরা প্রতিদিন নানা সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হই—কোন কাজটি করব, কী বলব, কার সঙ্গে সময় কাটাব, কীভাবে দিনটি কাটাব। এই সিদ্ধান্তগুলোই আস্তে আস্তে আমাদের জীবনের রূপ নির্ধারণ করে। কিন্তু একটা সূক্ষ্ম বিষয় আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না—আমরা কি সত্যিই এমন কাজগুলো করছি যা আমাদের জন্য ভালো, নাকি এমন কাজগুলো বেছে নিচ্ছি যা কেবল ভালো লাগে? এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটাই জীবনের মান নির্ধারণ করে।
আমাদের জীবনের বড় একটি অংশই চলে "ভালো লাগা"র খোঁজে। আমরা এমন কিছু করি যা মুহূর্তের জন্য আনন্দ দেয়, শান্তি দেয়, কিংবা মনকে আরাম দেয়। কিন্তু এই কাজগুলো সবসময় আমাদের জন্য উপকারী হয় না। যেমন—এক কাপ দুধ-চিনির কফি খেতে যেমন দারুণ লাগে, তেমনি শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারী ব্ল্যাক কফি, যদিও সেটা তিতা লাগে। এই ছোট উদাহরণটা একটা বড় সত্যকে তুলে ধরে—ভালো লাগা আর ভাল থাকা এক জিনিস নয়।
দার্শনিক অ্যারিস্টটল একবার বলেছিলেন, “We are what we repeatedly do. Excellence, then, is not an act, but a habit.” অর্থাৎ, আমরা যা বারবার করি, সেটাই আমাদের চরিত্র গঠন করে। সুতরাং যদি আমরা প্রতিদিন শুধুই ভালো লাগার কাজ করি— যেমন বিলম্ব, আলস্য, বা অপ্রয়োজনীয় ব্যয়— তবে সেটাই আমাদের অভ্যাসে পরিণত হবে এবং জীবনের পথে টেনে নামাবে।
ধরা যাক, এক কাপ দুধ-চিনির কফি। খেতে দারুণ লাগে, মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এতে চিনি ও দুধের ফ্যাট শরীরে জমে যায়। অন্যদিকে ব্ল্যাক কফি খেতে তিতা, কিন্তু এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, যা শরীরের জন্য অনেক উপকারী। একইভাবে, সকালে বেশি ঘুমালে শরীর আরাম পায়, কিন্তু ভোরে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটলে শরীর ও মন দুটোই চাঙা হয়। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটালে মুহূর্তের আনন্দ আসে, কিন্তু একটি ভালো বই পড়লে বা নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করলে আমাদের চিন্তাশক্তি ও জ্ঞান বাড়ে— যা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জীবনকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ সাধারণত তাৎক্ষণিক সুখ (instant gratification) খোঁজে, কারণ মস্তিষ্কের “ডোপামিন” নামের হরমোন এটি উৎসাহিত করে। কিন্তু প্রকৃত সুখ আসে “deferred gratification”-এ— অর্থাৎ, যেখানে আমরা দীর্ঘমেয়াদে উপকার পাই। উদাহরণস্বরূপ, টাকা সঞ্চয় করা হয়তো এখন কঠিন মনে হয়, কিন্তু ভবিষ্যতে এটি নিরাপত্তা এনে দেয়। অথবা, নিয়মিত ব্যায়াম করা হয়তো আজ কষ্টকর, কিন্তু সেটিই কাল আমাদের সুস্থ রাখে।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “The future depends on what you do today.” তাই আজকের প্রতিটি সিদ্ধান্তই আগামী দিনের জীবনকে গঠন করে। যদি আজ আমরা শুধু আরামের পথ বেছে নিই, তাহলে ভবিষ্যৎ হতে পারে অনিশ্চিত ও দুর্বল। কিন্তু যদি আমরা আজ কিছুটা কষ্ট স্বীকার করি, কিছুটা শৃঙ্খলা গ্রহণ করি, তাহলে ভবিষ্যৎ হবে দৃঢ় ও সুন্দর।
আমাদের সমাজেও এই পার্থক্যটা প্রতিফলিত হয়। যারা প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের উন্নতি ঘটায়, তারা ধীরে ধীরে সমাজে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে, যারা তাৎক্ষণিক আনন্দের পেছনে ছুটে বেড়ায়, তারা প্রায়ই নিজের সম্ভাবনা হারায়। এটা যেন নদীর মতো— যদি প্রবাহটি নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে তা শক্তি দেয়; কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন হলে, তা ধ্বংস ডেকে আনে।
আমেরিকান দার্শনিক জীম রন বলেছেন, “Discipline is the bridge between goals and accomplishment.” অর্থাৎ, লক্ষ্য এবং তা’ অর্জনের মাঝে সেতু হলো শৃঙ্খলা। এই শৃঙ্খলাটাই আসে তখনই, যখন আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করি— “আমি যা করছি, তা কি আমার জন্য সত্যিই উপকারী?”
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই আত্ম-প্রশ্নটাই আমাদের দিক নির্দেশ করে। অফিসে, পরিবারে, এমনকি সম্পর্কেও। কোনো তর্কে জিততে গিয়ে যদি সম্পর্ক নষ্ট হয়, তাহলে সেটা কি সত্যিই লাভজনক? না। একটু নরম হয়ে কথা বললে হয়তো মুহূর্তে মন খারাপ হবে, কিন্তু সম্পর্ক থাকবে অটুট।