
আমরা কি শিক্ষা ছাড়াই সবকিছু বদলে দিতে চাই
আমাদের দেশের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কয়েক ভাগে বিভক্ত। বেশির ভাগ মানুষ আমাদের চিরাচরিত পদ্ধতি অর্থাৎ স্কুল-কলেজে বাংলাদেশের শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত সিলেবাসের ওপর আস্থা রাখে। তারপরে আছে মাদ্রাসা কারিকুলাম—মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে আলিয়া মাদ্রাসা কর্তৃক প্রণীত সিলেবাস অনুসারে এখানে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। আছে কওমি মাদ্রাসা—এখানে সাধারণ মানের শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে তাদের পদ্ধতি আলাদা। এখানে হাদিস-কোরআন-আরবি শিক্ষাই বেশি দেওয়া হয়। সবশেষ হলো ইংরেজি মাধ্যম—এখানে ব্রিটিশ কারিকুলাম, আমেরিকান অথবা কানাডিয়ান কারিকুলাম অনুসারে শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত আছে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ শিক্ষাপদ্ধতি। সাধারণ মানুষ এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না।
মূল কথায় আসি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা সবকিছু বদলে দিতে চাই। বদলে দিতে পারি বা না-ই পারি, মুখে মুখে অন্তত বদলে দিতে চাই, বিপ্লব ঘটাতে চাই, আমূল পরিবর্তন করব—এই রকম হাঁকডাক দিয়েই যাচ্ছি সবাই মিলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেকগুলো কমিটি করা হয়েছে। একটি কমিটির বাস্তব রূপ দেখলাম গত শুক্রবার—সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অবশ্য আমার লেখার উপজীব্য এটা নিয়ে নয়। আরও অনেক কমিশন যে হয়েছে, আমরা সবকিছু বদলে দিতে চাই বলে, সেগুলোর অবস্থা কী—আমিসহ বোধ হয় কেউই এ সম্পর্কে ভালো কিছু ধারণা রাখেন না। যাই হোক, আমাদের সদিচ্ছা থাকলে সবকিছু বদলাবে। প্রশ্ন হলো, সবকিছু যে বদলাবে, সেটা কি ভালোর দিকে যাবে, উন্নতির দিকে যাবে, না নিম্নমুখী হবে? মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। আশা করি ভালোর দিকেই যাবে।
আমরা সবকিছুকে কেমন করে পরিবর্তন করব যেখানে শিক্ষাকেই গুরুত্ব দিতে পারছি না? গত বছর এইচএসসি পরীক্ষা হয়েছিল সাত বিষয়ে, অন্য পরীক্ষা হয়নি। আমাদের দেশের বিপ্লবী ছাত্ররা অর্থাৎ এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সচিবালয় ঘেরাও করে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছ থেকে অটোপাসের আংশিক সনদ নিয়ে এসেছিলেন। যাই হোক, সেই আংশিক অটোপাস দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হয়েছিলেন; আলোচনা হয়েছিল বিভিন্ন কলেজে বেশ কিছু আসন খালি ছিল। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যদিও অটোপাস পদ্ধতি ছিল না; যথানিয়মে পরীক্ষা হয়েছে, ফল দেখা গেল গড়ে ৫৮ শতাংশ পাস, বাকি ৪২ শতাংশ ফেল। মুক্ত পরিবেশে যখন সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে, আমরা মনে করেছিলাম সবকিছু ভালোর দিকে পরিবর্তন হবে, এ বছর পাসের হার আরও বেশি হবে। ফল হলো উল্টোটা।
এমনিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আমাদের কারিকুলামে যেসব বিষয়ে পড়ানো হয়, পশ্চিমা দেশে এতসব বিষয়ে না পড়িয়ে দরকারি বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। আমরা সেই পদ্ধতিতে এখনো যেতে পারিনি। তারপরও যদি পাসের হার এমন হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে। আমরা শুধু কথায় বলি, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। এখন প্রশ্ন ওঠে, এই মেরুদণ্ড কি ভেঙে যাচ্ছে, না ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ছে।
এ দেশের তরুণ ছাত্ররা গত বছর আন্দোলন করল। তাদের দাবি ছিল বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা, কোনো কোটা চায় না তারা, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে ও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সঙ্গে ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা। অথচ এখন পর্যন্ত আমরা তেমনভাবে লক্ষ করিনি, উল্লিখিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ছাত্রদের প্রতি ক্লাসে ফিরে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করার আহ্বান জানিয়েছেন এই বলে যে এ দেশ গড়তে হলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক দরকার। এককথায় বলতে গেলে বাস্তবমুখী শিক্ষা দরকার। মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টারও তেমন কোনো কথা শোনা যায় না।
কিছুদিন আগে আমি একটি জেলা শহরে গিয়েছিলাম, এখানে একটি সরকারি কলেজে অনার্স আছে। কোনো একটি বিভাগের চেয়ারম্যান আমার বন্ধু। আমি যথারীতি তাঁর রুমে ঢোকার পরে দেখলাম পাঁচজন ছাত্র বসে আছেন তাঁর সামনে। আমার বন্ধু খুবই বিনয়ের সঙ্গে একেবারে মোলায়েম ভাষায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন, চা-বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন। বন্ধু তাঁদের প্রতি খেয়াল রাখার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু ছাত্রদের মুখ থেকে একবারও শুনলাম না সুশিক্ষা পাওয়ার আবেদন করতে। এই পাঁচজন ছাত্র বের হয়ে যাওয়ার পরে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম তাঁরা কারা। বন্ধু একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, এরা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা। এরা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে যায়, কথাবার্তা বলে তাদের দলে টানার চেষ্টা করে, ভবিষ্যতে এখানে তারা নির্বাচন করবে, ছাত্রসংগঠন নির্বাচন, সেই ব্যাপারে তারা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বললাম, তারা তো লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলল না। বন্ধুর উত্তর, ‘আর বলিস না, এদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই কী ট্যাগ লাগিয়ে স্লোগান আরম্ভ করবে, সেই ভয়ে আছি।’
রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন—কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিবৃতি দিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে নির্দেশ দিল না যে, তোমরা শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো রকম তর্কে জড়াবে না, তাঁদের অপমান করবে না, তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করবে ইত্যাদি। এই ধরনের নীতিবাক্য কোনো সংগঠনের পক্ষে এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। শিক্ষকেরা ভয়ে থাকেন, ছাত্রদের কাছ থেকে কোনো হুমকি পান কি না। আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, গত শতকের সত্তর-আশির দশকের দিকে, তখন চিত্র ছিল উল্টো।
আমার আরেক বন্ধু, পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তাঁর সঙ্গে কথা বললে তিনি বললেন, এখন আর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস মন দিয়ে ছাত্ররা ফলো করে না। ছাত্ররা জানে প্র্যাকটিক্যালে শিক্ষকেরাই সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে দেবেন, তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য। মফস্বল স্কুলের হেডমাস্টারসহ সবাই মাথা নিচু করে স্কুলে যান, পাঠদান শেষে শিক্ষকদের সাহস হয় না ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করার, ‘তোমরা পড়াশোনা করেছ? হোমওয়ার্ক করে এসেছ?’ তাদের কাছে প্রশ্ন করতেও শিক্ষকেরা এখন কুণ্ঠাবোধ করেন। সবকিছুর ফল আমরা দেখলাম এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিক্ষাব্যবস্থা
- শিক্ষার মান