
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার করা সহজ
হাসনাত কাইয়ুম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি। হাওরের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে কারাভোগ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে নতুন করে দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ তুলেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
হাসনাত কাইয়ুম: হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্যের অনেকাংশের সত্যতা আছে। আবার তারা কোন মানদণ্ডে ব্যাপারগুলোকে দেখছে, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না। তবে এটা সত্য যে দুই ধরনের অভিযোগ এই সরকারের বিরুদ্ধে তোলা যায়। একটা হলো, অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয়তার জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য সরকারের সক্রিয়তা থাকা দরকার, সেখানে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আবার অন্য ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার মতো করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক আলোচনা সভা বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কি এমন কোনো অস্পষ্টতা আছে, যা এর অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করছে?
হাসনাত কাইয়ুম: সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কোনো অস্পষ্টতা বলে কিছু নেই। এই আইনটা নিজেই এমন যে এর অপব্যবহার করা সহজ। উল্টোভাবে বললে এ আইনটি অব্যবহার না করলেই নয়। বরং এর ব্যবহার করে রাজনৈতিক আলোচনা সভা বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। কারণ, এই আইনটা করা হয়েছিল রাজনৈতিক পরিসরে মানুষ যখন ক্ষোভ থেকে আন্দোলন করে এবং নিজ অভিব্যক্তির জায়গা থেকে প্রতিবাদ করে, তখন আইনশৃঙ্খলাবিরোধী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। এ আইনটাকে এখনো অগণতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এইচআরডব্লিউর এই অভিযোগ সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি?
হাসনাত কাইয়ুম: সেটা তো অবশ্যই সাংঘর্ষিক। কারণ, সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি যেভাবে হামলা করা হলো এবং শিক্ষকদের সঙ্গে যে আচরণটা করা হলো, মিছিলে যেভাবে জলকামান ব্যবহার করা হলো এবং তাঁদের ওপর পুলিশ যেভাবে চড়াও হয়েছে, নির্যাতন করেছে, যেভাবে শিক্ষকদের টেনেহিঁচড়ে আটক করেছে, সেটাকে কী বলা যায়? কোনো মানুষ এ ধরনের আচরণকে সমর্থন করতে পারে না।
এই সরকার যে মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার কিংবা আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আগের সরকারের মতো হবে না—এই অঙ্গীকার করেছিল। সেটা তো শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রেই বোঝা গেল। এগুলো তো হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্যাপার না শুধু। আমরা তো সবাই এসব দেখছি। এই সরকারের প্রধান সমস্যা, যেটা আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, যেখানে যেটা করার কথা না, সেখানে সেটাই করা হচ্ছে। শিক্ষকদের ওপর বলপ্রয়োগের কথা না, কিন্তু সেটাই করা হলো। যখন রাষ্ট্রের যেকোনো সেক্টরের পেশাজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে উত্থাপন করার জন্য আসছে, তাদের ওপরই বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
আর যারা মানুষের জান-মালের ক্ষতি করছে, মানুষের নিরাপত্তা নষ্ট করছে, তাদের বেলায় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এখন পুলিশকে ন্যায়ের পক্ষে নিষ্ক্রিয় হতে আর অন্যায়ের পক্ষে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসার পর অন্তর্বর্তী সরকার যে অঙ্গীকার করেছিল, সেটার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এর কারণ কী?
হাসনাত কাইয়ুম: প্রধানত তিনটা কারণে এসব হচ্ছে। প্রথমত, এ সরকারের অদক্ষতা। দেশ আসলে কীভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এবং এর জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়—এসব তারা জানে না। দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে যে বাহিনী ছিল তাদের কোনো ধরনের সংস্কার না করে এবং তাদের কোনো ধরনের সংস্কারের আওতায় না এনে, সেই বাহিনীর মনোবল ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে। তার মানে দাঁড়ায়, এই বাহিনীকে আগের মতোই আচরণ করার কথা বলা হচ্ছে। এ কারণেই তারা অনেক ক্ষেত্রে আগের মতোই আচরণ করছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নতুনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও গাইড করা হয়নি। এ কারণে তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যে জনগণের প্রতি মানবিক হওয়া দরকার, সে বিষয়ে কোনো ধরনের জ্ঞান, ধারণা ও ট্রেনিং নেই। যখন আবার এই বাহিনীকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে মূলত সরকারের অদক্ষতা এবং এই বাহিনীর সদস্যদের চরিত্রের অসংগতির কারণে। আর এই বাহিনী হলো চরিত্রগতভাবেই স্বৈরাচার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অপব্যবহার
- সন্ত্রাসবিরোধী আইন