
সংস্কার কমিশন পিছু হটল কেন
হঠাৎ করে রাজনীতির নিঃসীম নীলিমায় টুকরো টুকরো কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। এটি দেখা যাচ্ছে বলতে গেলে, অক্টোবরের শুরু থেকেই। বুধবার সন্ধ্যায় এ কলামটি লেখার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে একটি বহুল প্রচারিত অনলাইন বাংলা দৈনিকের প্রধান সংবাদের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘জুলাই সনদ নিয়ে নতুন সংকট, অতি জরুরি বৈঠক সন্ধ্যায়’। খবরে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
সেখানে দলটির পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান তুলে ধরা হয়। ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া আগানো না হলে এনসিপি সনদে সই করবে না বলে ওই বৈঠকে জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিপি বলছে, তারা মনে করে, এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের সময় তারা ছাড় দিয়েছে। এবার আর ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা সংস্কার, বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে নতুন করে পুরো আলোচনা শুরু করার পক্ষে।
অপর একটি বাংলা দৈনিকে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীও জুলাই সনদ স্বাক্ষর করবে কিনা এবং স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে হাজির হবে কিনা সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো (এ ভাষ্য লেখার সময় বুধবার রাত ৯টায়) গ্রহণ করেনি। বলা হয়েছে, বুধবারেই জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পরিষদের বৈঠক বসবে এবং সেখানে এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
তবে জামায়াতের একাধিক সূত্র এ ভাষ্যকারকে বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে জুলাই সনদের যে খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে, সেটা পড়ে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ সেখানে পিআরের কোনো কথা নেই, সনদ বাস্তবায়িত হবে কীভাবে, অর্থাৎ কীভাবে এ মুহূর্তে সেটি সংবিধানের অংশ হবে এবং গণভোট কবে হবে, এ সম্পর্কে সনদের খসড়ায় কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। এ অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে তারা মনে করেন, এ ধরনের একটি অসম্পূর্ণ খসড়ায় তারা সই করতে পারেন না। তবে এগুলো তাদের ব্যক্তিগত মতামত। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারা কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পরিষদে গ্রহণ করবেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, জুলাই সনদ নিয়ে গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে যুগান্তরের এ কলামে আমি যেসব উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম, সেখানে স্পষ্ট বলেছিলাম, জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। এখন সেই তফাতটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিএনপি জুলাই সনদের খসড়াকে মুক্তকচ্ছ সমর্থন দিয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বিএনপির তিন সদস্যের একটি টিম জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আমি ইতঃপূর্বে যুগান্তরে একাধিকার লিখেছি এবং আজও লিখছি, বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে তফাতটি মৌলিক। বিএনপি চায় বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। বিএনপির এ ব্যাপারে অবস্থান হলো, যেহেতু সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিমকোর্টের মতামত নিয়ে ইউনূস সরকার গঠিত হয়েছে, তাই ইউনূস সরকার তথা ইন্টারিম সরকার বর্তমান সংবিধানেরই ধারাবাহিকতায় একটি সাংবিধানিক সরকার।
পক্ষান্তরে জামায়াত এবং এনসিপি মনে করে, এ সরকার জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের অভিপ্রায় মোতাবেক গঠিত সরকার। সুতরাং, এ সরকারের স্থান সংবিধানেরও ঊর্ধ্বে। এনসিপি গত মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে দাবি করেছে, একটি সাংবিধানিক ফরমান বলে জুলাই সনদ ঘোষিত হোক। এর পর গণভোট হোক। যদি সাংবিধানিক ফরমান মোতাবেক জুলাই সনদ ঘোষিত হয়, তাহলে তারা নির্বাচনের দিন গণভোট হলেও তাদের আপত্তি থাকবে না। পিআরের ব্যাপারে তাদের অবস্থান হলো, নিুকক্ষে বর্তমান ব্যবস্থা, অর্থাৎ আসনভিত্তিক নির্বাচনে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআরভিত্তিক নির্বাচন হতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান হলো, তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চায় এবং সংসদের উভয় কক্ষেই তারা পিআর চায়। তারা নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের ওপর গণভোট চায়। এ গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর অনুমোদিত জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের দল ইসলামী আন্দোলন জামায়াতের অবস্থানের সঙ্গে একমত। কিন্তু বিএনপি বলে, যেহেতু ইন্টারিম সরকার একটি সাংবিধানিক সরকার, তাই সেই সাংবিধানিক সরকারের কোনো Constituent Power বা সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই। সে কারণেই কোন সাংবিধানিক ফরমান বলে জুলাই সনদ ঘোষণার ক্ষমতা ইন্টারিম সরকারের নেই।