
মানুষগুলো কেবলই সংখ্যা হয়ে যায়
এমন বলা হয়ে থাকে-‘একটি মৃত্যু শোকের, কিন্তু অধিক মৃত্যু কেবলই সংখ্যা’। আমাদের দেশের অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। যে মানুষগুলো রুটি-রোজগারের সন্ধানে সকাল বেলা কাজে এসেছিলেন তারা যে আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না-সেটি কি কেউ ভেবেছিল। কিন্তু হয়েছে তাই।
১৬ জন মানুষ রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনের ঘটনায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন। এ ঘটনায় আহতের সংখ্যাও অনেক। গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে এই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ নামের একটি পোশাক কারখানা এবং তার পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদামে আগুন পুড়িয়ে দেয় অনেক জীবন, বহু মানুষের স্বপ্ন।
অগ্নি দুর্ঘটনার পর নিয়মমাফিক বাণী বিবৃতি আসে শোক জানিয়ে। কিন্তু ঘটনা ঘটতেই থাকে প্রতিকারহীনভাবে। অগ্নি দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যান তো অনেক। তাহলে সেসব থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিই না কেন? প্রশাসন, গার্মেন্টস মালিক সংশ্লিষ্ট সবাই কেন ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন সরব থেকে চুপ হয়ে যাই। যতক্ষণ আরেকটা দুর্ঘটনা না ঘটছে। আসলে এগুলো কি দুর্ঘটনা নাকি মানুষের অবিমৃশ্যকারিতার ফল?
অতি লাভ ও লোভের আশায় আমরা ঢাকা শহরটাকে অ্যাটম বোমা বানিয়ে রেখেছি। যেখানে আবাসিক এলাকা সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে কেমিক্যাল গুদাম। একটা বিল্ডিং এর গা ঘেঁষে আরেকটি বিল্ডিং। সূর্যের আলোও ঢুকে না। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকবে তো দূরের কথা। শহরের ভেতরে তো গার্মেন্টস কারখানাও থাকার কথা না। ইপিজেড এলাকায় অথবা কোনো নিরাপদ স্থানে হবে গার্মেন্টস।
আরও কিছু পরিসংখ্যান হাজির করি। ফায়ার সার্ভিসের সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ২৭,৬২৪টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনাগুলোতে ৭৯২ কোটি টাকার বেশি সম্পদের ক্ষতি হয় এবং ১০২ জন নিহত হন। ২০২৪ সালে সারাদেশে মোট ২৬,৬৫৯টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪০ জন, আহত হয়েছেন ৩৪১ জন। ২০২৫ সালের প্রথম ৭ মাসে ১৫৪ জন আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গেছেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। তাছাড়া সারা ঢাকা শহরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা ৪,৮৫০টিরও বেশি গোডাউনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে মিরপুর ও উত্তরা রয়েছে। এসব তথ্য আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত করে।
দুই.
অগ্নি দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ, এবং নিয়মকানুন না মানা। এই দুর্ঘটনা রোধে ভবন নির্মাণের সময় অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিয়মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করা, এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কী করণীয় সে বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
অনেক ভবন নির্মাণে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না। ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের অপব্যবহার থেকে প্রায়শই আগুনের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের অবহেলাজনিত আগুন, গ্যাসের চুলা বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থের কাছাকাছি খোলা আগুন রাখা বা ভুল ব্যবহার করা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অগ্নি দুর্ঘটনা