
আমাদের শিক্ষকেরা কেমন আছেন
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবরে প্যারিসে আন্তসরকার সম্মেলনে ইউনেসকো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে শিক্ষকের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণীত হয়। এতে শিক্ষক নিয়োগ, দায়িত্ব, পদোন্নতি, অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান-শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্যারিস সম্মেলনের এ দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। এ দিবসটিতে জাতি গঠনের মূল কারিগর শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের প্রত্যাশা করা হয়। এ দিবসে শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা এবং তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়। এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’। এতে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
জাতি গঠন ও জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান অসামান্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য-দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের সব দেশে-সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সর্বাধিক এবং তাঁরাই সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকের অবস্থা তার উল্টো। এ দেশের শিক্ষকেরা সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। আর্থিক দৈন্য ও সামাজিক বঞ্চনা বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের নিত্যসঙ্গী। তবে তাঁদের বঞ্চনা-দুঃখ-যাতনা বেশির ভাগই অব্যক্ত থাকে।
একই সিলেবাস ও প্রশ্নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য ক্যাডারের চেয়ে নিচে ধরা হয়! অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা পদবিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদেরও মেনে চলতে হয়! স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের স্নাতক পাস মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে হয়! শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষাপ্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে শিক্ষকের চেয়ে অশিক্ষকের প্রাধান্য ও গুরুত্ব বেশি দেখা যায়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষকের বেতনকাঠামো এসএসসি/অষ্টম শ্রেণি পাস কর্মচারীদের মতো বিবেচনা করা হয়। এখনো অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন বা ঝাড়ুদাড়ের ব্যবস্থা না থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ শিক্ষকদেরই করতে হয়! পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অপ্রাপ্তিতে অনেক শিক্ষককে পেশাগত হতাশায় ভুগতে হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতার ন্যায্য অধিকারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। একই পাঠ্যক্রমে ও একই নিয়মে পাঠদান সত্ত্বেও সমযোগ্যতাসম্পন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের ব্যাপক বৈষম্য বঞ্চনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বেসরকারি শিক্ষকদের এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি ও উচ্চতর গবেষণা পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিবেচনা না করায় বৈষম্যের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষকের বেতনকাঠামো ও পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা-বঞ্চনা শিক্ষক সমাজে হতাশা বাড়ায়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুল-মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর শিক্ষকদের নির্ভর করতে হয়। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের সুবিধা এবং স্বেচ্ছাচারিতায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। তাই চাকরি রক্ষার্থে অনেক সময় আত্মমর্যাদা ভুলে শিক্ষককে তোষামুদে হতে হয়!
নন-এমপিও (সরকারি অনুদানবহির্ভূত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা জীবনযাপন করেন সবচেয়ে করুণ অবস্থায়। পাঠদানের অনুমোদিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি-সংস্থার দানে প্রতিষ্ঠিত মক্তব, কওমি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার অধিকার অসচেতন শিক্ষকদের করুণ অবস্থা অবর্ণনীয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে ন্যায্য অধিকার, বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সভা-সমাবেশ ও রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকদের নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়!
অস্বীকার করার উপায় নেই, কিছুসংখ্যক অসৎ-অযোগ্য লোকও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে পেশাবহির্ভূত বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রভাব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিছুসংখ্যক শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষার্থী ধর্ষণসহ অনেক অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ আছে। সংখ্যায় বেশি না হলেও তাঁরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় অন্যায়-অপকর্ম ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে শিক্ষক সমাজের ভাব-মর্যাদা নষ্ট করছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসা করে অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে আছে। তবে অর্থনৈতিক দৈন্য ঘোচাতে কোনো কোনো শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষায় নিজ প্রতিষ্ঠানের ফলাফল ভালো করতেও কিছু শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্ব শিক্ষক দিবস