গাজার গণহত্যা একটি সাধারণ ঘটনার মতো প্রতিদিন নিহতের সংখ্যা জানাচ্ছে। আজকে ১০০, আগের দিন ৯৫, এভাবে নিত্যদিনের নিহতের সংখ্যা দেখে দেখে বিশ্ববাসী অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অসহায় পরিস্থিতি খুব কমই এসেছে, যখন একতরফা হত্যা প্রতিকারহীনভাবে চলেছে। গাজায় তেমনটিই হয়েছে। শুধু হত্যা নয়, খাদ্য, ওষুধ, জরুরি মানবিক সাহায্য থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হলেও গাজার পক্ষে বৈশ্বিক প্রতিবাদ হয়েছে কমই। বিশ্বনেতৃত্বের উদ্যোগী ও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সামান্যই। বরং আসল চিত্র হলো এই যে, গাজায় প্রতিদিন পাখির মতো মানুষ হত্যার বিপরীতে বিশ্বনেতৃত্বের মৌনব্রত আর মুসলিম শাসকদের অক্ষমতাই হলো প্রকৃত বাস্তবতা।
গাজার গণহত্যা দেখতে দেখতে এবং বিশ্বনেতৃত্বের প্রহসনমূলক আচরণ ও কথা শুনতে শুনতে বিশ্ববাসী যখন ক্লান্ত, অবসন্ন ও নির্জীব, তখন মানবতা নামক শব্দটি আর সাহস নামের বৈশিষ্ট্যটি পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে বলে মনেই হচ্ছিল না। আর ঠিক তখনই অবরুদ্ধ-উপদ্রুত গাজার মানুষের প্রতি সহমর্মিতার প্রত্যয়ে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সাহসী মানুষদের অভিযাত্রা মানবতার নব জন্ম দিয়েছে এবং সাহসের নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। অক্ষম পৃথিবীর অসহায় মানুষ এবং ব্যর্থ শাসকদের সামনে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি, যার ফলে সাগর থেকে মাটি পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়েছে ইসরাইলের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিবাদ এবং গাজার প্রতি সমর্থন ও সংহতি।
যে বিশ্বখ্যাত ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে একদা এশিয়ায় এসেছিল ক্রুসেডার এবং ইউরোপে গিয়েছিল মুসলিম বিজেতা মুসার মুজাহিদ বাহিনী, সেই অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্রের একুয়ামেরিন জলের কল্লোলে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সঞ্চারিত করেছে দ্রোহ ও প্রতিবাদের সীমাহীন ঢেউ। দুর্বল শাসক এবং নিষ্ক্রিয় বিশ্ববাসীর কাছে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সাহসী উপস্থিতি বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষকে প্রণোদিত করছে। একইসঙ্গে বিশ্ববাসীর সামনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে গণহত্যার প্রতিবাদে মানবিক ও সাহসী মানুষের কর্তব্য তুলে ধরছে এবং অক্ষম ও দুর্বল শাসকের অবদমিত প্রতিচিত্র উন্মোচিত করেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গাজায় গণহত্যা ও মানবিক সংকট যখন নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা, তখন ফ্লোটিলার সাহসী মানুষদের অভিযাত্রা এক শিহরণ জাগানিয়া সঞ্জীবনী রূপে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির হয়ে নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পথ দেখিয়েছে এমন এক পর্যায়ে, যখন গাজায় দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ, ইসরাইলি সামরিক অভিযানে অকাতরে সাধারণ মানুষের মৃত্যু এবং মানবিক বিপর্যয়কে বহু দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা গণহত্যা বা গণসংহার বলে অভিহিত করতেও রাজি হয়নি। চায়ের পেয়ালা হাতে বিশ্ব মোড়লরা আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে গাজার গণহত্যা ও রক্তস্রোত এড়িয়ে। প্রতিবেশী আরব দেশগুলো রয়েছে নতজানু অবস্থায়। গাজা প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাপী অক্ষমতার চূড়ান্ত প্রদর্শনীর মধ্যে ফ্লোটিলা এক দুর্বার সাহসের নাম। যার মূল উদ্দেশ্য গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ওষুধ পৌঁছে দেওয়া। এমন ঘোরতর গণহত্যার মধ্যে এ উদ্যোগকে ‘মানবতার পক্ষে সাহসী পদক্ষেপ’ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ, হন্তারক ইসরাইল ত্রাণকর্মী ও ডাক্তার-নার্সকেও রেহাই দিচ্ছে না। ফলে সেখানে যাওয়া মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার শামিল। ফ্লোটিলার ভয়হীন মানুষেরা মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গিয়ে সেই সাহস ও মানবিকতার পরিচয় দিলেন।
বিশ্বের নানা দেশের অধিকার কর্মীর সমন্বয়ে গঠিত ফ্লোটিলার অংশগ্রহণকারী দল সত্যিই এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ, যাতে বাংলাদেশি ও বাঙালি বংশোদ্ভূতদের উপস্থিতির ঘটনা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য উদ্দীপনামূলক। প্রতিনিধি দলের একেকজন আদর্শ সাহসী নাগরিক, যারা যুদ্ধনীতি-অমানবিকতা, দুর্ভিক্ষ ও নিপীড়নের এবং প্রতিনিয়ত ঘটমান গণহত্যার প্রতিবাদে জীবনবাজি রেখে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বাংলাদেশের শহিদুল আলমের মতো বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক, মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে ইতিহাসে তাদের স্থান নিশ্চিত করেছেন।
কেন প্রতিবাদী অধিকার কর্মীদের জীবনবাজি রেখে ত্রাণ ও সাহায্য নিয়ে অবরুদ্ধ-উপদ্রুত গাজা অভিযাত্রায় শরিক হতে হলো? কারণ, একটাই। আর তা হলো বিশ্বনেতৃত্বের সীমাহীন ব্যর্থতা, ক্ষমার অযোগ্য অক্ষমতা এবং অকার্যকর অবস্থান। দিনে পর দিন চলমান গাজা গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পটভূমিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কর্তাদের এবং বড় বড় শক্তি ও দেশ বা জাতিসংঘের ভূমিকা সত্যিই বেদনাদায়ক। বস্তুত তাদের সম্মিলিত অবস্থান হত্যাকারীদের সহায়ক হয়েছে। অনেকেই শুধু বিবৃতি দিয়েছে, কোনো কার্যকর প্রতিরোধ বা মানবিক করিডর খুলে দেওয়ার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অনেকেই, বিশেষত মুসলিম দেশগুলো মুখ লুকিয়ে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ভয়ে। গাজার রক্তবন্যায় সমগ্র জগৎ নীরব দর্শক হিসাবেই থেকেছে, যা শাসকদের কূটনৈতিক ও নৈতিক দুর্বলতার এবং সামরিক অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
এমনই একতরফা ও আগ্রাসী পরিস্থিতিতে ফ্লোটিলার সাহসী মানুষদের গাজা অভিযাত্রা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে; গাজা একটি মানবিক মৃত্যুকূপে পরিণত হলেও কিছু সাহসী মানুষ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পিছপা হননি। জীবনের বিনিময়ে তারা গাজাবাসীর জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাধীন ফিলিস্তিনের ন্যায়সংগত দাবিকে উচ্চারিত করেছেন। শক্তির রণহুঙ্কারের বিরুদ্ধে মানবতা যে এখনো জীবন্ত রয়েছে, ফ্লোটিলার সাহসী মানুষদের গাজা অভিযাত্রা তারই প্রমাণ বহন করছে। একইসঙ্গে এ সত্যকেও প্রকট করেছে যে, গণহত্যার বিপরীতে, কয়েকজন সাহসী মানুষের প্রতিবাদ মানবিকতা ও নৈতিকতার প্রতীক হয়ে বৈশ্বিক ঘটনায় পরিণত হতে পারে। প্রমাণ করতে পারে যে, গাজার গণহত্যায় হন্তারকরা যতই শক্তিশালী হোক, প্রতিবাদের, নিন্দার, ঘৃণার ঊর্ধ্বে নয়। আর দুর্বল, শাসকরা ইতিহাসে কেবলই অক্ষম চরিত্র মাত্র।