এক বছর আগে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে রূপান্তর ঘটে চলেছে। ১৯৭২-৭৫-এর আওয়ামী-বাকশালী ফ্যাসিবাদী শাসন ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তখন সদ্যস্বাধীন দেশে তার প্রভাব পড়েছিল ব্যাপকভাবে।
আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্টদের পালটা কার্যক্রম
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারসহ শেখ মুজিবুর রহমানের পতনের দুমাস পর (৩ নভেম্বর) ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্টরা যখন পালটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় তৎক্ষণাৎ অজনপ্রিয় আওয়ামী-বাকশালীদের জনসম্মুখে আনতে পারেনি এই শক্তি।
অভ্যুত্থানকারী নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেলখানায় নিহত চার নেতাকে ঢাকায় তিন নেতার মাজারের কাছে কবর দেওয়ার অনুমতি দেননি। উপরন্তু তিনি বাকশালী পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এগুলো করেও খালেদ মোশাররফ তার গা থেকে ভারতের দুর্গন্ধ দূর করতে পারেননি।
সৈনিক এবং জনগণ জিয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়
জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে রাখায় জনগণ খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ঠিক তখনই ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট আরেক বিকল্প শক্তি, জাসদ এবং এর সহযোগী সশস্ত্র সংগঠন গণবাহিনীর মাধ্যমে ঢাকা সেনানিবাসে আরেকটি পালটা অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতোমধ্যেই জিয়াউর রহমানকে তার পক্ষের সৈনিকরা মুক্ত করে ফেলে। জিয়া তৎক্ষণাৎ সাহসিকতার সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসের সিপাহিদের বিপ্লবের কমান্ড নিজের হাতে তুলে নিয়ে ভোর ৫টায় জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে অনুরোধ করেন।
জাতির ক্রান্তিকালে জিয়া দুইবার বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি হলো ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ডাক, আরেকটি হলো ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতির ডাক।
আধিপত্যবাদী শক্তির বিভিন্ন স্তরের পরিকল্পনা
ওপরের ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশকে করায়ত্তে রাখার জন্য আধিপত্যবাদী ভারত কত লেয়ারে (স্তরে) পরিকল্পনা করে রাখে। আওয়ামী লীগকে সরিয়ে রেখে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ) দৃশ্যপটে এনে জিয়াউর রহমানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় ভারত। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। জিয়াউর রহমানের ১ নম্বর শত্রু হয়ে যায় জাসদ আর ২ নম্বর শত্রু হিসাবে থাকে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন
প্রেসিডেন্ট জিয়া যদি ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত না করার আদেশ দিতেন কারও কিছু বলার ছিল না। তবুও কেন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। জাসদকে রাজনৈতিক মাঠে মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটানো হয়। সেসময় জেনারেল জিয়াউর রহমান এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ভবিষ্যতে হতে পারে-এ নিয়ে কেউ তখন তেমন মাথা ঘামায়নি। তবে সিদ্ধান্তটি জাতির জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায় এবং বুমেরাং হয়ে পরে জাতির দিকে ফিরে আসে। জিয়াউর রহমানের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যে ধীরে ধীরে সরীসৃপের মতো সামনে এগিয়ে যাবে, তা ভাবা উচিত ছিল তখনকার রাজনীতিকদের। জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিত্ব এবং জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে, তার সামনে গিয়ে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করতে হয়তো সাহস করেননি কেউ।
ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি
এদিকে আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এর মাত্র ১৩ দিন পর ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্টরা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে।