অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপ চললেও জাতীয় নির্বাচন, জুলাই সনদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও এনসিপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে।
শুধু তাই নয়, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিবিরোধী যে জোটের কথা বলা হচ্ছিল, সেটি অনেকটা আনুষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে। যার তৎপরতা শুরু হয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস ও খেলাফত আন্দোলনের যুগপৎ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। তাতে অনেকের মনে এই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে যে, বিএনপিবিরোধী এই জোট কি ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের অংশ?
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন ‘মাইনাস টু’ বলতে বোঝানো হতো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ নেত্রীকে। যদিও তখন সেটি সম্ভব হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে ‘মাইনাস টু’ সামনে আসছে। বলা হচ্ছে, এবারের ‘মাইনাস টু’ দুজন ব্যক্তির নয়, বরং দুটি দলের। অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে দেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে কার্যত মাইনাস। কেননা এরই মধ্যে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করে মাইনাস করে দেওয়া হয়েছে। আর মূল দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ। ফলে নির্বাচন কমিশনে তাদের প্রতীকও স্থগিত। এমতাবস্থায় এটি ধরে নেওয়াই সঙ্গত যে, যদি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না। তার মানে মাইনাস ওয়ান কমপ্লিট। বাকি থাকে দেশের আরেক বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অতীতের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান হিসাব করে এটা মনে করা হয় যে, একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য, রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকলে; মব সন্ত্রাস দমন করা গেলে বিএনপিই সরকার গঠনের মতো আসন পাবে। সে কারণেই বিএনপিকে মাইনাস করা তথা তাকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিতে বিএনপিবিরোধী বড় জোট গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আসছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলোর বাইরে বাকি যারা সক্রিয় ছিল, তার মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত থাকলেও এই দুটি দলের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বেড়েছে। বিএনপির সঙ্গে থেকে জামায়াত ক্ষমতায়িত হয়েছে মনে করা হলেও এখন জামায়াত নিজেই ‘স্বনির্ভর’। অভ্যুত্থানের পরে জামায়াত এককভাবে শক্তিশালী এবং বিএনপিকে তাদের এখন আর ‘পাত্তা দেওয়ার’ প্রয়োজন নেই—এমন ন্যারেটিভও আছে। কিন্তু জামায়াত কি এককভাবে সরকার গঠনের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে? এ কারণে জামায়াতের সঙ্গে অন্য ইসলামিক দলগুলো, বিশেষ করে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ আরও কিছু দলের জোট গঠনের গুঞ্জনও রয়েছে।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে সত্যি সত্যিই নির্বাচনি জোট হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও বিএনপিকে ঠেকাতে এ মুহূর্তে সক্রিয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন এবং তার কিছু লক্ষণও স্পষ্ট। বিশেষ করে জুলাই সনদ, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, ভোটের আগেই বিচার ও উল্লেখযোগ্য সংস্কারের দাবিতে বিএনপিকে একঘরে করে ফেলার একটা পরিকল্পনা যে চলছে, তা সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেই মনে হয়েছে।