
দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনীতির বার্তা
‘জেন-জি’ নামে পরিচিত তরুণদের তীব্র আন্দোলনের মুখে হিমালয়ের দেশ নেপালের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা পদত্যাগ কিংবা পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেছেন। সহিংসতা ও ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনায় নেপালে তরুণদের আন্দোলন সর্বাত্মক গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে; একই রকম আন্দোলন আগে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে ঘটেছে। ২০২৪ সালের জুলাই ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আমূল বদলে দেওয়ার স্পৃহায় ভরপুর, যা রাজনৈতিক প্রতিরোধের এক মডেল হিসাবে নেপালের পার্বত্যভূমিকে স্পন্দিত করেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা থেকে আন্দোলনের কর্মকৌশল
গবেষক অনুপম দেবাশীষ রায়ের ‘বিদ্রোহ থেকে বিপ্লব’ বইটি ২০১৮ সালের ব্যর্থ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের সফল ছাত্র অভ্যুত্থানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, আন্দোলনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি স্মার্টকৌশল, স্পষ্ট ভাষা এবং সামাজিক মাধ্যমে সুসংগঠিত প্রচার। ছাত্রদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দেওয়া আন্দোলনের জন্য পরিণত হয় একটি নৈতিক যুদ্ধঘোষণায়। ছাত্ররা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সরকারের বৈধতাকে নৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে।
জুলাই আন্দোলন নিয়ে রচিত প্রথম বইতে (‘Student Protest and Hasina's Downfall in Bangladesh’, আগস্ট ২০২৪, ঢাকা : স্টুডেন্ট ওয়েজে) ড. মাহফুজ পারভেজ আন্দোলনকে শাসনের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রশ্নবিদ্ধ বৈধতা এবং গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থার অবক্ষয়ের দ্বারা নিজের সর্বাত্মক পতনকে দৃশ্যমান করেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে তরুণ প্রজন্ম ফুঁসেছে। পাকিস্তানের বেলুচ, পাঠান অঞ্চলের তারুণ্যের দ্রোহ আলোড়ন জাগিয়েছে। নেপালে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের আন্দোলনের লেন্সে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকালে শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও জনবৈষম্য স্পষ্ট হয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও জনস্বার্থে মোটেও মনোযোগী না হওয়ায় গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি ছিল অবশ্যম্ভাবী।
আন্দোলনের অভিন্ন পটভূমি
সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তরুণদের মধ্য থেকে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আওয়াজ উঠে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে। তারা প্রবীণদের তুলনায় বেশি প্রতিবাদী, প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত, দুনিয়ার উদ্ভাবন বা ঘটনা অবগত, সচেতন, আকাক্সক্ষী এবং নিজেদের অধিকারে সোচ্চার। তরুণ প্রজন্ম চরিত্রগত এ বৈশিষ্ট্য সামাজিক মাধ্যমের সহায়তায় দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও বিক্ষোভ-আন্দোলন চাঙা করতে সফল হয়।
আন্দোলন ছোট ও ক্ষুদ্র সমস্যার প্রতিক্রিয়া হলেও ক্রমশ তা বৃহত্তর আকার ধারণ করে। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একটি চমকপ্রদ, অভিন্ন প্রতিরোধের কাঠামো, যা গঠিত হয়েছে প্রজন্মগত পরিচয়, ডিজিটাল অবকাঠামো এবং ঐতিহাসিক স্মৃতির ব্যবহারের মাধ্যমে। এ উদীয়মান রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ বহুলাংশে উগ্র, সহিংস এবং রক্তাক্ত, যা একটি প্রতিরোধ মডেল রূপে একুশ শতকের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করছে।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে রোষের মতোই নেপালে প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ২৬ সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার কারণে। উভয় ক্ষেত্রেই তরুণ সমাজ নিজেদের অবদমিত মনে করে সরকারের পক্ষে তাদের অধিকার ও কণ্ঠরোধের বিরোধিতা করেছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা প্রথাগত রাজনৈতিক কর্মী, তথা দলীয় অনুগত, শ্রমিক সংগঠক বা গ্রামীণ কর্মী ছিল না। তারা ছিল শহুরে ডিজিটালি দক্ষ তরুণ প্রজন্ম। এদের রাজনীতি করার কথা ছিল না। রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হওয়ার কথা তো ছিলই। কিন্তু তারাই হয়েছে ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র। কারণ, তারা চেতনাগত দিক থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও আনপ্রেডিক্টেবল। মোটেও তাদের পিতামাতার মতো নয়, যারা রাজনৈতিক পার্টি ও মতাদর্শের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করতেন। বর্তমান প্রজন্ম ও তাদের বন্ধুদের রাজনীতি গঠিত হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সংকীর্ণ অর্থনৈতিক সুযোগের প্রতিবাদের মাধ্যমে। তাদের জন্য প্রতিরোধ শুধুই সংস্কারের জন্য নয়, এটি আত্মমর্যাদা, অস্তিত্ব এবং ন্যায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নতুন রাজনৈতিক ধারা
- জেন-জি