
জুলাই সনদ নিয়ে অসন্তুষ্টি : জামায়াত ও এনসিপি কতদূর যাবে
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে : ‘If wishes were horses, beggars would ride’. অনুবাদ : মানুষের ইচ্ছাগুলো যদি ঘোড়া হতো, তাহলে ভিক্ষুকরাও ঘোড়ায় চড়ত। এটি অন্তত ৪০০ বছর আগের প্রবাদ। কিন্তু আক্ষরিক অর্থ বাদ দিলে সমাজ ও রাজনীতির ব্যাপক পরিসরে এ প্রবাদটি আজও প্রযোজ্য। ৩১ আগস্ট প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠকে ড. ইউনূস ভালো নির্বাচন সম্পর্কে যে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সেই আশাবাদ শুনে ওই প্রাচীন প্রবাদবাক্যটির কথা মনে পড়ল।
প্রধান তিনটি দল ছাড়াও ২ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা হেফাজতে ইসলাম, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টিসহ সাতটি দলের সঙ্গে বৈঠকেও একইরকম উক্তি করেন। এসব বৈঠকে তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটি হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হবে। সব ভোটার ভোট দিতে যাবেন। এটি হবে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন।
এ নির্বাচন একটি ভালো নির্বাচন হবে। হয়তো সেখানে কোনো কারচুপি থাকবে না। হয়তো ভোটার টার্নআউট সন্তোষজনক হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর হবে? নির্বাচনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করেও ওই সংশয় প্রকাশ করতেই হচ্ছে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার দেশের তিনটি দলকে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল হিসাবে ট্রিট করছে। এ তিনটি দল হলো-বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং দেশের মধ্যেও ওই নির্বাচনের কথা বলেছেন।
ড. ইউনূসই প্রথম বলেছিলেন, জুলাই বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার, ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের বিচার ও নির্বাচন। জনগণের তরফ থেকে কোনো দাবি না উঠলেও ড. ইউনূসই প্রথম দফায় ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। পরবর্তীকালে তিনি আরও পাঁচটি সংস্কার কমিটি গঠন করেন। মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এগুলো ছাড়াও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অর্থনীতিতে ১৫ বছরের দুর্নীতি ও লুণ্ঠন খুঁজে বের করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। ওই টাস্কফোর্স কয়েক মাস খাটাখাটনি করে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে, তাতে দেখা যায়, শেখ হাসিনার আমলে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশের টাকায় অন্তত আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে। এছাড়া খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ঘুস, দুর্নীতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, এসব ক্ষেত্রে লাখ কোটি টাকার ওপর দুর্নীতি নয়, পুরোপুরি লুণ্ঠন হয়েছে। পাচার হওয়া আড়াই লাখ কোটি টাকা, লুণ্ঠন করা লাখ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা-প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিপরীতে গত ১৩ মাসে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটি দেশবাসীকে এখনো জানানো হয়নি।
বিডিআর ম্যাসাকার নিয়ে বিপ্লবের পর কত তোলপাড় হলো। কত ইনভেস্টিগেটিভ অর্থাৎ অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট ও ইউটিউব ভিডিও ভাইরাল হলো। জনমতের চাপে বিডিআর ম্যাসাকার তদন্তের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটি নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছিল; কিন্তু হঠাৎ করে ওই তদন্ত শম্বুকের গতি প্রাপ্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই তদন্ত রিপোর্ট আদতেই দিনের আলোর মুখ দেখবে কি না, সেটি নিয়ে ওইসব মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
২.
শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামাদের ম্যাসাকারের ব্যাপারে কোনো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি কেন? কোনো দল বা ব্যক্তি আইসিটিতে মামলা করেছেন, সেটি তো ব্যক্তিগত বা দলীয় পর্যায়ে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন? আর একথা কে না জানে, বিডিআর ম্যাসাকার এবং শাপলায় আলেম-ওলামাদের ম্যাসাকার ছিল শেখ হাসিনার জন্য টেস্ট কেস। এ দুটি টেস্ট কেসে তিনি সফল হন। তার দুটি হাতই রক্তরঞ্জিত হয় এবং এ রক্তক্ষয়ী অপারেশনের সাফল্য তাকে আরও বেশি করে কনফিডেন্ট করে তোলে। পরবর্তী বছরগুলোয় শেখ হাসিনা যে একজন সাইকোপ্যাথ ও ডাইনিরূপে আবির্ভূত হন, তার পাটাতন গড়ে দিয়েছে এ দুটি গণহত্যা। অথচ সেই দুটি গণহত্যা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। কেন? এসব তদন্তের উদ্যোগের প্রতি কোন বাজপাখি তার কালো থাবা বিস্তার করেছে?