
দারিদ্র্য বিমোচনের তত্ত্ব ও বিশ্ব অভিজ্ঞতা
‘দারিদ্র্য কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি মানুষের তৈরি এবং মানুষের দ্বারাই দূর করা সম্ভব।’—নেলসন ম্যান্ডেলা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে দারিদ্র্য সবসময়ই এক অদৃশ্য শত্রু হিসেবে বিরাজ করেছে। যুগে যুগে দারিদ্র্য শুধু অর্থনৈতিক অনটন নয়, বরং সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষার অপ্রাপ্যতা, স্বাস্থ্যসেবার সংকট এবং সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতারও প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ যখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) ঘোষণা করে, তখন প্রথম লক্ষ্য হিসেবে ‘দারিদ্র্যের অবসান’-কেই বেছে নেয়। কারণ, দারিদ্র্য দূর না হলে উন্নয়নের অন্য কোনো স্তম্ভই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে দারিদ্র্য দূর করা যায়? সময়ের সাথে সাথে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রনায়কেরা নানা তত্ত্ব হাজির করেছেন। কোনো কোনোটি ব্যর্থ হলেও আবার কিছু তত্ত্ব একেক দেশে বিস্ময়কর সাফল্য এনে দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো কেবল ইতিহাস নয় বরং নীতি প্রণেতাদের জন্য দিকনির্দেশনা। এসব বিষয় নিয়েই আজকের এই লেখা।
কোন তত্ত্ব কোন দেশে ব্যবহৃত হয়েছে, কীভাবে সাফল্য এনেছে এবং বাংলাদেশ তার থেকে কী শিক্ষা নিতে পারে, সে বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এই লেখা থেকে পাওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দ্রুত গতিতে এগোতে থাকে। এই সময়ে অর্থনীতিবিদদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করতেন ‘Trickle-down theory’-তে। এ তত্ত্বে বলা হয়, যদি অর্থনীতির শীর্ষ স্তরের ধনী ও কর্পোরেট গোষ্ঠী আরও ধনী হয়, তবে তাদের ভোগ বৃদ্ধি, নতুন বিনিয়োগ এবং শিল্প সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যার সুফল নিচের স্তরের গরিব মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাবে। অর্থাৎ ধনী শ্রেণির আয়ের প্রবাহ ধীরে ধীরে সমাজের নিম্নস্তরে ‘ঝরে পড়বে’।
বাস্তবে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রে এই তত্ত্ব আংশিকভাবে সত্য হলেও এর সীমাবদ্ধতা অত্যন্ত প্রকট ছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী হলো, নতুন প্রযুক্তি ও শিল্পক্ষেত্রের কারণে উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বেড়ে গেল এবং শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হলো।
শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ভোক্তা সংস্কৃতির প্রসার সমাজে এক নতুন গতি আনল। কিন্তু অন্যদিকে, আয়-বৈষম্যও দ্রুত বৃদ্ধি পেল। ধনী শ্রেণির সম্পদ অভূতপূর্বভাবে বেড়ে গেলেও সমাজের নিচের স্তরের জনগণ সেই অনুপাতে লাভবান হয়নি। ফলে ‘ট্রিকল-ডাউন’ শুধু আংশিক উপকার এনেছিল, কিন্তু দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মূল সমস্যাকে সমাধান করতে পারেনি।
এখান থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়—
(১) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য হলেও একে একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখা যায় না;
(২) প্রবৃদ্ধি যদি সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সমতা-নির্ভর নীতির সঙ্গে সমন্বিত না হয়, তবে তা বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তোলে;
(৩) ইতিহাস প্রমাণ করেছে, শুধুমাত্র ধনীদের ওপর নির্ভর করে সম্পদ ‘নিচে নেমে আসবে’ এই ধারণা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর নয়; বরং রাষ্ট্রকে সক্রিয়ভাবে আয়-বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হয়।
অতএব, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রয়োজন দ্বিমুখী কৌশল—একদিকে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, কর-নীতি ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সরাসরি উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়া। না হয় ‘Trickle-down theory’ শুধু ধনীদের আরও ধনী করে, গরিবদের দুরবস্থা স্থায়ী করে তোলে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দারিদ্র্য দূরীকরণ
- বৈষম্য দূর