
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংস্কার এক বছরে যা দেখলাম
হাসিনা যুগের শেষ দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেখা দেয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতের সংকট, রিজার্ভের তীব্র ঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ। বছরের পর বছর ধরে জনতুষ্টিবাদী ব্যয় এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করার ফলে দেশের আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা হয়ে ওঠে ভঙ্গুর এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেমে যায় ঐতিহাসিক নিম্নস্তরে। জনগণের অর্থ দলীয় কর্মসূচিতে, যা প্রায়ই ডিজিটালাইজেশন বা আইটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ছদ্মবেশে হতো—অপচয় করা হয়েছে। বহুল আলোচিত মেগা প্রকল্প, যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উচ্চ ব্যয়, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা এবং প্রশ্নবিদ্ধ আয়ের বোঝা বয়ে চলেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমি প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ায় (পিটিআই) লিখেছিলাম, ২০২৫ সালের মধ্যে একটি বড় ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ছাড়া গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতির টিকে থাকা একটি অলৌকিক ঘটনা হবে। কিন্তু আমার অনুমানের চেয়ে অনেক আগেই হাসিনার শাসনের পতন ঘটে, যা ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি বিধ্বস্ত দেশ ও ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে যায়। এ অর্থনীতির জরুরি ভিত্তিতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন সুদূরপ্রসারী সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। এটি কোনো বিলাসিতা ছিল না, বরং ছিল এক চরম বাধ্যবাধকতা, যার উদ্দেশ্য ছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের নতুন এজেন্ডা নির্ধারণ করা। এক বছর পেরিয়ে এখন প্রশ্ন করা প্রাসঙ্গিক: কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার সাফল্য এনেছে, কোথায়-বা এটি ব্যর্থ হয়েছে এবং সামনে কী করা উচিত?
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার: সাফল্য ও ঘাটতি
গত এক বছরে একটি দৃশ্যমান সাফল্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। সরকার খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল করতে কিছু লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন আমদানি চ্যানেলগুলোর কঠোর তদারকি, বাফার স্টক ছাড় এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করা, ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমেছে। যদিও সাধারণ মানুষ এখনো জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তবে মূল্যবৃদ্ধির গতি এক বছর আগের তুলনায় ধীর হয়েছে, যা মজুরি উপার্জনকারীদের কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
ব্যাংক খাত স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রেও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণ (এনপিএল), রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ঋণখেলাপি এবং তারল্য সংকটে জর্জরিত ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর ঋণ শ্রেণীকরণ বিধি এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতকরণের মাধ্যমে কিছুটা আস্থা ফিরিয়ে এনেছে। আমানতকারীদের আস্থা বেড়েছে, যদিও মূল দুর্বলতাগুলো এখনো রয়ে গেছে।
এর পরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর তারল্য সরবরাহ ছিল অপর্যাপ্ত। সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল এখনো উচ্চ মাত্রার অকার্যকর ঋণের বোঝায় জর্জরিত এবং রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা তহবিল পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থ খাতের বাইরে সংস্কারের গতি ছিল অমসৃণ। শ্রমবাজার একটি বড় সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হলেও তা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
অভ্যন্তরীণভাবে শ্রমবাজারে নতুন তরুণদের আগমনের তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি পিছিয়ে ছিল। কৃষিসংযুক্ত ভ্যালু চেইন বা ক্ষুদ্র আকারের উৎপাদন শিল্পের মতো শ্রমঘন খাতে বিনিয়োগ ছিল দুর্বল। অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা জালের সঙ্গে এটি যুক্ত হয়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংকের।
বৈদেশিক বাজারের দিক থেকে প্রবাসী শ্রমবাজার পর্যাপ্ত সহায়তা পায়নি। নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, উন্নত প্রশিক্ষণ ও অভিবাসীদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষার এখনো অভাব রয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য খোলা হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান, যদিও জাপানে দক্ষ জনশক্তি রফতানিতে সহযোগিতার অঙ্গীকার একটি আশার আলো দেখাচ্ছে।
রাজস্ব আহরণের দিকটিও হতাশাজনক ছিল। সরকার ২০২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কর, শুল্ক ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের সমর্থন ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কারের প্রচেষ্টা রাজনৈতিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ফাংশনগুলোকে আলাদা ইউনিটে—রাজস্ব নীতি (Revenue Policy) এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (Revenue Management)—বিভক্ত করলে ২০২৮ সালের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানের ৮-৯ শতাংশে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কার একটি জরুরি কিন্তু অসমাপ্ত এজেন্ডা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দুর্বল নীতি প্রয়োগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার পেশাদারত্ব আনার কথা বললেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ—যেমন কার্যনির্বাহী স্বাধীনতা বাড়ানো, তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোকে আধুনিকীকরণ এবং নীতিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা—এখনো নেয়া হয়নি। এ ধরনের সংস্কার ছাড়া ব্যাংকিং স্থিতিশীলতায় অর্জিত সাফল্য সাময়িক হতে পারে।
সর্বোপরি আরেকটি হতাশার জায়গা হলো চুরি করা অর্থ পুনরুদ্ধার। বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্যসংক্রান্ত চালানে ফাঁকিজুঁকি দেয়া হয়েছে, অবৈধ স্থানান্তর এবং ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও প্রকৃত পুনরুদ্ধার ছিল নগণ্য। বিশ্বাসযোগ্য আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব ও শক্তিশালী দেশীয় তদন্তক্ষমতা ছাড়া এ সমস্যা টিকে থাকবে।
অলিগার্ক শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, স্বৈরাচারী শাসন কেবল রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মাধ্যমেই নয়, বরং একটি শক্তিশালী অলিগার্ক শ্রেণীর উত্থানের মাধ্যমেও টিকে ছিল। এ অলিগার্করা—রাজনৈতিক আনুগত্যসম্পন্ন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী—ক্ষমতাসীন দলগুলোকে অর্থায়ন করে, প্রধান শিল্পগুলো দখল করে এবং গণমাধ্যম ও সংসদে তাদের প্রভাব বিস্তার করে স্বৈরাচারী কাঠামোকে সুসংহত করে। অর্থ ও রাজনীতির এ সংমিশ্রণ এমন একটি ‘প্লুটোক্রেসি’ বা বিত্তবানদের শাসন তৈরি করেছে, যেখানে অর্থনৈতিক ক্ষমতা নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রূপান্তর হয়।
এটি কেবল বাংলাদেশের জন্যই অনন্য নয়। ফিলিপাইন থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে স্বৈরাচারী চুক্তি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অলিগার্করা ছিল কেন্দ্রীয় চরিত্র। নীতির চ্যালেঞ্জটি দ্বিমুখী: অলিগার্কদের বাজার একচেটিয়া করা থেকে বিরত রাখা এবং রাজনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ সীমিত করা।