শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি শাসনামলের যত ইচ্ছা সমালোচনা করুন এবং তার জন্য যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক প্রমাণ রয়েছে—গত ৭ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারেও এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কোনোভাবেই হেয় করবেন না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সর্বোচ্চ গর্বের উৎস, এর জন্য এ দেশের মানুষ সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ চিরস্থায়ীভাবে আমাদের মন, মনন ও চেতনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃত ইতিহাস কখনোই অবমূল্যায়ন সহ্য করবে না। কৃত্রিম ইতিহাসের কথা ভিন্ন, সেগুলো কখনোই সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকে না। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা যে জুলাই ঘোষণাপত্রটি উপস্থাপন করলেন, সেটা কি গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য ছিল না? অতীতের দমনমূলক শাসনের কারণে যে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি, সেটা অর্জনের রোডম্যাপ কি এই ঘোষণাপত্রটি হওয়ার কথা ছিল না?
সেটা না করে আমরা দেখলাম ইতিহাসের পুনর্লিখন।
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান যাই হোক না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে অবস্থান, তার একটি ভিত্তি থাকা উচিত। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করলেন এবং যেটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটা কেবল আমাদের ইতিহাসের 'পছন্দসই অংশ বাছাই করে নেওয়া'র উদাহরণ।
জুলাই ঘোষণাপত্রের দুটি প্যারায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, যার মাধ্যমে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সেখানে ঔপনিবেশিক শাসন ও ২৩ বছরের 'পাকিস্তানি কর্তৃত্ববাদী শাসনের'র উল্লেখও রয়েছে। বলা হয়েছে, '১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি।' পরবর্তী প্যারায় বলা হয়েছে, '…বাংলাদেশে মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য…যা সমতা, মানব মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত…।'
এভাবেই ২৩ বছরের পাকিস্তানি সামরিক ও দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম উপস্থাপন করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে উল্লেখ নেই আমাদের ভাষা আন্দোলন, নেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরপরই ছাত্র হত্যার ঘটনা এবং 'একুশে ফেব্রুয়ারির' জন্ম কথা। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের কথাও সেখানে নেই, যে নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের পক্ষে কথা বলার বৈধতা দিয়েছিল। সেই নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার কারণেই পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ওপর নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত হামলা চালানো মাত্রই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই নির্বাচনই আমাদের 'অস্থায়ী সরকার' গঠন ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ভিত্তি ছিল—যা ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
আরও লজ্জার বিষয়, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূস যে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছেন, সেখানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই কালোরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর 'গণহত্যা'র কোনো উল্লেখ নেই। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কি না, তা নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, লাখো নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল কেবল বাঙালি ও পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার অপরাধে।