
পরিবহন নেতাদের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে
দেশের সড়ক পরিবহন খাতে দীর্ঘদিন ধরে যে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা চলছে, তাতে বোঝা যায় এই খাতের নিয়ন্ত্রণ এখন আর রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর হাতে নেই। এটি চলছে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের কথায়। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ বারবার পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ছে। তাঁরা ধর্মঘট ডেকে জনজীবন অচল করে দেওয়ার মতো চরম পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করছে না।
আগের সরকারের আমলে নিরাপদ সড়কের সব উদ্যোগ আটকে গেছে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের চাপে। তৎকালীন সরকার সমর্থক পরিবহন নেতারা ধর্মঘটসহ নানা আন্দোলন করে বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও একই পথে হাঁটছেন পরিবহননেতারা। এখন নেতৃত্বে আছেন বিএনপিপন্থী পরিবহননেতারা।
এবার পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস ও ট্রাক সড়ক থেকে উচ্ছেদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন পরিবহন খাতের নেতারা। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী থাকে মেয়াদোত্তীর্ণ যান এবং বেপরোয়া গতি। এই মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানো ও মানুষের মৃত্যু, হত্যার শামিল।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ যানবাহনের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে ৩০ বছর করাসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে। দাবি না মানলে ধর্মঘটের মাধ্যমে পরিবহন খাত অচল করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন পরিবহন খাতের নেতারা।
পরিবহন নেতাদের এমন দাদাগিরি নতুন কিছু না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল সড়ক খাতে বিশৃঙ্খলা। পরিবহন খাত অনেক দিন ধরেই দুষ্টচক্রে আটকে আছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে পারলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেরই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
বর্তমান সরকারের পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। বর্তমান সরকার ব্যর্থ হলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সড়ক খাতের দানবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে—এটা আশা করা হবে বোকামি।
যদিও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ১১ মাসে সড়ক খাতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি৷ সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামেনি, বাসমালিকদের টার্মিনালে চাঁদা দিতে হচ্ছে, সড়কে পুলিশকে টাকা দিতে হচ্ছে। যাত্রীদের কাছ থেকেই মালিকেরা আদায় করছেন এসব খরচ। চুক্তিতে চালক-সহকারীর কাছে বাস ছেড়ে দিচ্ছেন মালিকেরা।
এখনো যেকোনো বড় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পর দেখা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট যানবাহনের ফিটনেস ও রুট পারমিট নেই৷ দেশজুড়ে এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও রুট পারমিটবিহীন বাস এই মালিকেরাই পরিচালনা করেন। চালক হিসেবে নেন লাইসেন্সহীন ব্যক্তিদের। আবার এই চালকদের জন্যই পরিবহন নেতারা আইন সংশোধন করে জামিন অযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য ও জরিমানার পরিমাণ কমাতে বাধ্য করেছে।
বেপরোয়া বাস চালানো ও রেষারেষি বন্ধে সরকার ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার উদ্যোগ নেয় সাত বছরের বেশি সময় আগে। এই ব্যবস্থায় হাজার হাজার মালিক থাকবেন না। ঢাকায় পাঁচটি কোম্পানির অধীন বাস চলবে। একাধিকবার চালুর উদ্যোগ নিয়েও এই কার্যক্রম সফলতার মুখ দেখেনি। পরিবহনমালিকদের বাধা ও আপত্তির মুখে বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি আলোচনাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করেছিল। মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে এটি কার্যকর করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। আইনটি সংশোধনের দাবিতে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে সারা দেশ কার্যত অচল করে দেন।
পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে ২০১৯ সালের শেষ দিকে আইন সংশোধন করে প্রায় প্রতিটি ধারা শিথিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সড়ক আইনে ৪২টি ধারায় অপরাধ এবং কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ৩৪টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আসে। আইনে যতগুলো ধারা সংশোধনের মাধ্যমে শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে, তার প্রায় সব কটিই পরিবহনচালক, মালিক ও কর্তৃপক্ষের শাস্তিসংক্রান্ত।
২০২৪ সালের ১৩ মার্চ মন্ত্রিসভায় ‘সড়ক পরিবহন (সংশোধন) আইন ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। বিদ্যমান আইনের অন্তত ১২টি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। সড়ক পরিবহন আইনটি মালিক বা শ্রমিকের বিরুদ্ধে ছিল না; দুর্ঘটনা রোধই ছিল এর উদ্দেশ্য; কিন্তু পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা এটিকে দেখছেন তাঁদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে। এখনো তাঁরা এই আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পরিবহন নেতা
- সড়ক পরিবহন আইন