চব্বিশের জুলাইয়ে ‘ভালো মানুষ’ যখন নীরব ছিল

প্রথম আলো হাসান ফেরদৌস প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৬:১৫

১৯৬৩ সাল। আমেরিকার কালো মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে জেলে গেছেন মার্টিন লুথার কিং। কিন্তু দমে নেই, বার্মিংহাম জেলে বসেই তিনি দেশের কৃষ্ণকায় মানুষদের নাগরিক অধিকারের আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। দেশজুড়ে ধরপাকড়, গোপন নজরদারি। জেলে গেছে হাজার হাজার মানুষ। শ্বেতকায় গুন্ডারা প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে কালো মানুষদের। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কৃষ্ণকায়দের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।


ঠিক এমন সময় আন্দোলন প্রত্যাহার করার অনুরোধ নিয়ে মার্টিন লুথার কিংকে একটি চিঠি লিখলেন আটজন শ্বেতকায় ধর্মযাজক। তাঁরা ড. কিংকে অনুরোধ করলেন, এই অস্থির সময়ে গণ-আন্দোলন না করে উচিত হবে দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখা।


হতবাক হলেন ড. কিং। যে আটজন পাদরি তাঁকে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন। কৃষ্ণকায়দের অধিকারের প্রতি তাঁরা এর আগে নৈতিক সমর্থনও জানিয়েছেন। লড়াই যখন শ্বেত আধিপত্যের ব্যূহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে, তখন সে লড়াইয়ে শামিল হওয়ার বদলে তাঁরা ময়দান ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তাব করছেন। উত্তরে ড. কিং লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠি, যা বার্মিংহাম জেল থেকে পাঠানো চিঠি নামে পরিচিত।


ড. কিং লিখলেন, এই প্রজন্মে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে শুধু খারাপ মানুষের বিষাক্ত কথাবার্তা ও সহিংস কর্মের জন্য নয়, ভালো মানুষের নিন্দনীয় নীরবতার জন্যও।


এরপর আরও কয়েকবার ড. কিং ‘ভালো মানুষদের লজ্জাজনক নীরবতা’র নিন্দা জানান। ১৯৬৫ সালে সেলমা থেকে মন্টোগোমারি পদযাত্রার সময় তিনি লিখলেন, ভালো মানুষদের এই লজ্জাজনক নীরবতা আমাদের সময়ের গভীরতম একটি ট্র্যাজেডি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় চোখের সামনে বর্বরতার প্রমাণ পেয়েও যারা চুপ করে ছিল, ড. কিং তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমাদের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন আমাদের নীরবতা ভাঙতে হয়।


১৯৬৮ সালে, তাঁর মৃত্যুর সামান্য আগে, ড. কিং লিখলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এমন লোকের অভাব নেই, যারা চোখের সামনে ভয়াবহ মানবিক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে, অথবা জেগে জেগে ঘুমায়। অনেকে হয়তো অজ্ঞতার কারণে সত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। এই বিশ্বে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো এসব মানুষের ‘আন্তরিক অজ্ঞতা ও সচেতন মূঢ়তা’।



ভয়াবহ বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আমাদের জীবদ্দশায় কম ঘটেনি। সে অপরাধের কথা জেনেও চুপ করে থেকেছে—এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের কাছে সবচেয়ে দীপ্যমান উদাহরণ ১৯৭১। যারা এখনো সে গণহত্যাকে অস্বীকার করে, অথবা তার ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখে, তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই মুহূর্তে গাজায় গণহত্যার কথা আমরা ভাবতে পারি। মাত্র গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস–এ ভাষ্যকার ব্রেট স্টিফেন্স লিখেছেন, না, গাজায় কোনো গণহত্যা হচ্ছে না। একই কথা বলেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, গাজায় যা হচ্ছে, তাকে কোনোভাবেই জেনোসাইড বা গণহত্যা বলা যায় না।


মার্টিন লুথার কিং এই ‘ভালো মানুষদের’ লজ্জাজনক ব্যবহারকেই ট্র্যাজেডি বলে উল্লেখ করেছিলেন।


শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের ১৫ বছর বাংলাদেশে লাগামহীন অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও যারা হয় নীরব থেকেছে অথবা তার পক্ষে সাফাই গেয়েছে, আমার ধারণা, মার্টিন লুথার কিং তাদেরও সেই একই লজ্জাজনক ভালো মানুষদের তালিকায় ফেলতেন। এমন লোকের অভাব নেই, যারা এখনো পতিত সেই সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার অন্য যুক্তি হাতড়ে বেড়ায়। তারাও সেই তালিকার সদস্য।


শেখ হাসিনার আমলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে আকাশছোঁয়া দুর্নীতি। আইন ও বিচারব্যবস্থা পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রের নিপীড়নযন্ত্রে। দেশের ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেওয়া হয়েছে একটি মাফিয়া চক্রের হাতে। বাক্‌স্বাধীনতাকে নিরাপত্তাহুমকি বলে তালাবন্দী করা হয়েছে। পুরো দেশকে পরিণত করা হয়েছে একটি পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে।


গত বছর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল এই লাগামহীন দুর্নীতি, অধিকারহীনতা ও গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নাগরিক প্রতিবাদ। এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নেহাত কম নয়, যাঁরা নিজ চোখে ছাত্র-জনতার হত্যা দেখে কেবল নীরবই থাকেননি, তার সাফাইও গেয়েছেন।


কেউ কেউ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ রক্ষায় অথবা মৌলবাদের উত্থান ঠেকাতে কিছু মানুষের মৃত্যু—হোক না তা অন্যায় বা অবৈধ—মেনে নেওয়া যায়। জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে, অনেক বুদ্ধিজীবী দল বেঁধে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের আনুগত্য ঘোষণা করে এসেছেন। তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন, বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে নিলে দেশ শত্রুর হাতে চলে যাবে। অন্য কথায়, শত্রু আর কেউ নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। শাসকগোষ্ঠী জনতাকে শত্রু ভাবতেই পারে, কিন্তু দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীরাও যখন সেই একই কথা বলেন, তখন লজ্জায় মাথা নোয়াতে হয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও