
ট্রাম্পযুগে আমেরিকায় ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি!
শুধু বাংলাদেশই যে ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছিল তা নয়, পার্শ্ববর্তী ভারতেও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মন্ত্রে দীক্ষিত ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জেঁকে বসার পর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো, বিশেষ করে মুসলমানরা সেখানে ফ্যাসিবাদী আচরণের শিকার হচ্ছে। বিজেপি নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে তারা প্রতিনিয়ত খুন-জখমের শিকার হচ্ছে। মসজিদ, মাজার, মাদ্রাসাসহ পবিত্র স্থানগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ ছাড়িয়ে আমেরিকার মতো ‘মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মহান গণতান্ত্রিক দেশে’ ভিন্নরূপে ফ্যাসিবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখলে তাতে সবার বিস্ময় সৃষ্টির কারণ ঘটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই আমেরিকায় ফ্যাসিবাদী রাজনীতি, যা এতদিন বর্ণবিদ্বেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন প্রকাশ্য রূপ গ্রহণ করছে। ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের’ আমেরিকান দাবিদাররা ভীতিকর ফ্যাসিবাদী ভাষা প্রয়োগ করতে শুরু করেছে, যা সব উদারপন্থিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এর পরিণতিতে প্রাথমিকভাবে অভিবাসী কমিউনিটির অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ছে; এবং সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, একশ্রেণির রাজনীতিবিদের উচ্চারিত ফ্যাসিবাদী ভাষা সমগ্র আমেরিকান সমাজ-কাঠামোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে যাচ্ছে।
রক্ষণশীল রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২০) ফ্যাসিবাদের যে বীজ বপন করেছিলেন, তা অঙ্কুরোদগমের সময়ে তিনি হোয়াইট হাউজের বাইরে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের (২০২৫-২৮) সূচনাতেই তিনি ফ্যাসিবাদের চারাকে বেড়ে ওঠার জন্য লালন করছেন ক্ষমতার ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে। তিনি তার বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা প্রয়োগে কোনো রাখঢাক করেন না, এমনকি তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুকে হুমকি দিতেও দ্বিধা করেন না। ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ঔপন্যাসিক ও শিক্ষাবিদ টনি মরিসন বলেছিলেন, ‘ভাষা শুধু ক্ষমতা প্রয়োগের কলকাঠি নয়, ভাষার উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ আমাদের যৌথ ভবিষ্যৎকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। যেখানে সত্য ও ক্ষমতার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে, নীরবতা যেখানে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং যেখানে বিচারকের ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লায় সুবিচার ঝুলে থাকে, সেখানে প্রতিটি শব্দ বা বাক্যের অংশ একটি যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টি করে।’
নব্য ফ্যাসিবাদের উত্থান অন্তত মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিরোধ করতে বা পালটা আক্রমণ করতে আমেরিকানরা হয়তো বেপরোয়াভাবে উপযুক্ত নতুন শব্দ অনুসন্ধান করছে; কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উগ্র সামরিক ভাষার মোকাবিলা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এটি কেবল কথামালার লড়াই নয়, বরং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে দিচ্ছেন। প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যম ট্রাম্পের পদক্ষেপের প্রশংসা করছে। তারা ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদের আদর্শকে শুধু প্রতিরক্ষা দেওয়ার চেষ্টাই করছে না, বরং ফ্যাসিবাদী আচরণকে দেশপ্রেম বলে তুলে ধরছে। এ সংকট থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনতে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার চেতনার দিকে ফিরে যাওয়ার ওপর তাগিদ দিচ্ছে ট্রাম্পবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো। তারা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের কথামালার রাজনীতি এবং মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্বৈরাচারী ভাষার প্রয়োগ। যে ভাষা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল, তিনি তা ফিরিয়ে আনছেন আমেরিকানদের মাঝে সংঘাত সৃষ্টির জন্য।
অনেকে মনে করেন, অতি রক্ষণশীল আমেরিকান, যারা গণতন্ত্রের বিকাশের যুগে তাদের বর্ণবিদ্বেষ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের উগ্রতাকে এতদিন পর্যন্ত আড়াল করে রেখেছে, ঘৃণা ব্যক্ত করার শব্দগুলো উচ্চারণ করেনি, তারা এখন সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় শক্তির সঙ্গে যদি নিপীড়নমূলক ভাষা ব্যবহৃত হয়, তাহলে রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের কর্তব্য পালনকালে শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে শাসকের ব্যবহৃত ভাষার অমানবিক, বিদ্রূপাত্মক ও বিদ্বেষমূলক শব্দ প্রয়োগ করার ছাড়পত্র পেয়ে যায়। এসব শব্দের পাশাপাশি তারা সাধারণ অভিযুক্তকেও কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করে, দৈহিক পীড়ন চালাতে নির্মম হয়ে ওঠার মাঝে আত্মমুগ্ধতার স্বাদ পায়। এর উদ্দেশ্য একটিই-নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা।
আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যতদিন পর্যন্ত জয়জয়কার অবস্থা ছিল, তখন মনে করা হতো, প্রশাসন যে দলেরই হোক না কেন, তারা অন্তত আইনের শাসন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। কিন্তু ‘সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই’। রক্ষণশীলরা ট্রাম্পকে তাদের ত্রাণকর্তা হিসাবে পেয়েছেন, যিনি ‘আমেরিকাকে আবারও মহান’ দেশে পরিণত করবেন। ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শুধু আমেরিকাকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার স্লোগান নয়, তার সমালোচকদের মতে, ট্রাম্পের মুখে এটি বর্ণবাদী স্লোগান। ট্রাম্পের আগেও রোনাল্ড রিগ্যান, বিল ক্লিনটনসহ অনেকে প্রায় একই ধরনের স্লোগান দিলেও কেউ তাদের দ্বারা ‘আমেরিকাকে মহান’ করার স্লোগানকে সন্দেহের চোখে দেখেননি। কিন্তু ট্রাম্পের দ্বারা এ স্লোগানকে খুব কমসংখ্যক আমেরিকান সন্দেহমুক্ত দেখেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ স্লোগান সম্পর্কে আমেরিকান অভিনেতা ব্রায়ান ক্র্যানস্টন মন্তব্য করেছেন : ‘একজন আফ্রিকান-আমেরিকান অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য কবে কখন আমেরিকা মহান ছিল? আপনি যদি আবারও আমেরিকাকে মহান করতে চান, সেখানে নিশ্চয়ই তাদের (আফ্রিকান-আমেরিকানদের) অন্তর্ভুক্ত করবেন না।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- ফ্যাসিবাদী
- ডোনাল্ড ট্রাম্প