
জোরপূর্বক ৮০ লাখ পুরুষকে বন্ধ্যা করেছিল ভারত
সময়টা ১৯৭৬ সালের নভেম্বরের এক শীতের রাত। সবাই দৌড়ে পালাচ্ছিল। কেউ জঙ্গলের দিকে, কেউ আশপাশের গ্রামে, কেউ বা সরকারি কর্মকর্তাদের ভয়ে লুকিয়ে পড়ছিল কুয়োর ভেতর। তবে মোহাম্মদ দীনু ছিলেন স্থির। উত্তর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াট অঞ্চলের উত্তাওয়ার গ্রামের বাসিন্দা তিনি। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরের সেই ঠান্ডা রাতে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল, গ্রামের সব প্রজননক্ষম বয়স্ক পুরুষকে মাঠে জমায়েত করতে হবে।
সে সময় ভারত দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষিত জাতীয় জরুরি অবস্থার ১৭ মাস পার হচ্ছিল। ওই সময়ে দেশের সব নাগরিক স্বাধীনতা কার্যত স্থগিত ছিল। হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিচার ছাড়াই জেলে পাঠানো হয়েছিল। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতায় শুরু হয়েছিল ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ‘জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি।’
মোহাম্মদ দীনু এবং তাঁর আরও ১৪ জন বন্ধু এই কর্মসূচির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। পুলিশ তাঁদের জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় অব্যবস্থাপনা আর অযত্নে ভরা বন্ধ্যাকরণ শিবিরে। দীনুর চোখে এটি ছিল এক ধরনের ‘ত্যাগ’, যা নাকি গ্রামের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করেছে।
বর্তমানে ফিরে এসে ভাঙাচোরা একটি খাটে বসে ৯০ বছর বয়সী দীনু সেই দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘সবাই যখন নিজেদের বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিল, গ্রামের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ বুঝেছিলেন, কেউ ধরা না পড়লে আরও বড় বিপদ আসবে। তাই গ্রামের কিছু পুরুষকে একত্র করে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের ত্যাগের মাধ্যমে এই গ্রামকে বাঁচিয়েছি। চারপাশে দেখো, আজ গ্রামের প্রতিটি কোনায় আল্লাহর দেওয়া শিশুরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে।’
বিশ্বের ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বলে দাবি করা ভারত আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন যে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, সেই দিনের বার্ষিকী পালন করছে। আর উত্তাওয়ারে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণের শিকার পুরুষদের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন একমাত্র মোহাম্মদ দীনু।
১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত চলা জরুরি অবস্থার সময়, ভারতে ৮০ লাখের বেশি পুরুষকে জোরপূর্বক ভ্যাসেক্টমি বা বন্ধ্যাকরণের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। শুধু ১৯৭৬ সালেই এই সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ। অব্যবস্থাপনার কারণে অন্তত ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
- ট্যাগ:
- আন্তর্জাতিক
- পুরুষের বন্ধ্যাত্ব