
নারীর চোখে এনসিপি: নতুন ‘বন্দোবস্তে’ পুরোনো বৈষম্য ও বিপন্ন আশাবাদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া দলটি ‘নতুন বন্দোবস্তের’ স্লোগান দিয়ে নিজেদের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক হিসেবে তুলে ধরেছে; বিশেষ করে নারীর নেতৃত্ব, অংশগ্রহণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রশ্নে এনসিপির বাণীতে অনেকে আশার আলো খুঁজেছেন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে দল গঠনের আগে ও পরে দলের নেতা-কর্মীদের ঘিরে একের পর এক ঘটনা সেই প্রত্যাশার বিপরীত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষ করে, নারীর প্রতি দলটির অবস্থান বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে সামনের সারিতে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত দলটি এখন যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সেই ঘটনার শুরু হয় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারের সঙ্গে এক নারীর অডিও ফাঁস হওয়ার পর। সেখানে তুষারের পক্ষ থেকে যৌন হয়রানিমূলক কথাবার্তা শোনা যায়। অডিওতে নারী কণ্ঠটি যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাজনূভা জাবীনের বলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তাজনূভার চরিত্রহনন শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে। তাজনূভা ফেসবুকে জানান, ওই নারী তিনি নিজে নন, তবে কে তা জানেন।
কয়েক দিনের জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটে যখন এনসিপির এক সংগঠক নীলা ইস্রাফিল প্রকাশ্যে আসেন। তিনি তুষারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন। তাঁর দাবি, বিষয়টি নিয়ে ঈদুল আজহার দিনে সংগঠনের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জানালেও বিষয়টির সমাধান পাননি। কেন্দ্রীয় নেতার আচরণের বিষয়ে তিনি ঢাকা মহানগর শাখার নেতাদের সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুষারের পক্ষ হয়ে নীলাকে আক্রমণ শুরু হয়, এতে এনসিপির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও যুক্ত হন। এমনকি দলের নারী নেত্রীরাও তাঁর পাশে দাঁড়াননি বলে নীলার অভিযোগ। এর মধ্যে এনসিপির পক্ষ থেকে তাজনূভা জাবীনের একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। সেটি ফেসবুকে শেয়ার করে তাজনূভা যে পোস্ট দিয়েছেন, তাতে নারী বিষয়ে দলের অবস্থান নিয়ে সুস্পষ্ট অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে।
এর আগে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেওয়া হয়। ওই সমাবেশে এনসিপির প্রভাবশালী নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন, বক্তব্য দিয়েছেন। হাসনাতের বিষয়টির প্রতিবাদ না করা বা সমাবেশ বর্জন না করায় বেশ সমালোচনা হয়। তা ছাড়া নারীর সমান অধিকারের পক্ষে এনসিপির স্পষ্ট অবস্থান নেই। শুরুর দিকে সামান্থা শারমিনকে এনসিপির মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একাধিক অনুষ্ঠানে নারী বিষয়ে দলের অবস্থান নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত দেখা গেছে। এনসিপির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত জাতীয় নাগরিক কমিটি ছেড়ে যাওয়া শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিও নারী বিষয়ে নেতৃত্বের দুর্বলতার কথ তুলে ধরেছেন।
নীলা ইস্রাফিলের অভিযোগ
মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে এনসিপির প্রতি আস্থা ও ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছেন নীলা ইস্রাফিল। তিনি গণ-অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয় ছিলেন এবং এনসিপি গঠনের প্রাক্-পর্বেই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সারোয়ার তুষারের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্পর্ক ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে বলে দাবি করেছেন নীলা।
ফেসবুক বিবৃতিতে তিনি বলেন, তুষার তাঁকে নানা সময় ‘আপত্তিকর বার্তা’ দিয়েছেন, যেমন ‘তোমার ঠোঁট সুন্দর’, ‘তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠ আমাকে আকৃষ্ট করে’ ইত্যাদি। নীলা প্রথমে বিষয়টি গোপনে মীমাংসার চেষ্টা করেন এবং ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের জানান। এমনকি তুষারের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি দলের ভেতরে এ বিষয়ে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এর বদলে তিনি দেখেন, তাঁকে দলের বিভিন্ন সেল থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে এবং তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার শুরু হয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অভিযোগ জানানোর পরও এনসিপি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেয়নি; বরং অডিও ফাঁস হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ‘চাপে পড়ে’ সারোয়ার তুষারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। নীলা দাবি করেছেন, গত ঈদের রাতে এক অনুষ্ঠানে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে তিনি বিষয়টি জানালে নাহিদ ‘মহানগরের দায়িত্বে থাকা’ নেতাদের বিষয়টি অবগত করতে বলেন। তা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে, এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব যথাযথ সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিষয়টি ডিল করেনি। একপ্রকার এড়িয়েই গেছে। কারণ, সারোয়ার তুষার কেন্দ্রীয় নেতা, ঢাকা মহানগর কমিটি তাঁর বিষয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি কীভাবে করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনীতিতে নতুন দল