
স্বৈরাচারের পুনরুত্থান ঠেকানোর কী উপায়
আমরা সবাই জানি, শেখ হাসিনা ট্যাংকে চড়ে বা উর্দি পরে ক্ষমতায় আসেননি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, যদিও নির্বাচনটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তিনি ক্ষমতায় এসে সংবিধানও বাতিল করেননি। বিদ্যমান আইনি কাঠামো, নিয়ম-পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানই তাঁকে স্বৈরাচারে পরিণত করেছিল।
যদিও আইনি কাঠামোর পরিবর্তন, বিশেষত সংসদে ব্রুট মেজরিটি (ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা) ব্যবহার করে, একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে এবং বিভিন্ন কালাকানুনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাঁর স্বৈরাচার হওয়াটা ত্বরান্বিত ও আরও পাকাপোক্ত হয়েছিল।
ক্ষমতা গ্রহণকালে যেসব বিরাজমান নিয়ম-পদ্ধতি শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারে পরিণত করতে সহায়তা করেছে, তার অন্যতম হলো বারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া।
প্রথিতযশা লেখক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত ড. আকবর আলি খানের মতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার জার ও ভারতের মোগল সম্রাটের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান।
আমাদের সংবিধানপ্রণেতারাই ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদকে এত ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরাই রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন করে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করেছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৮(৩) অনুযায়ী কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রের অন্য সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর একক ‘কর্তৃত্বে’ পরিচালিত হয়, যদিও সত্যিকারের সংসদীয় সরকার পরিচালিত হয় মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে। আর সেই মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হন সব মন্ত্রীর মধ্যে প্রধান। অর্থাৎ আমাদের সংবিধানপ্রণেতারাই প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে ক্ষমতায়িত করেছেন।
এরপর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির হাতে বহুলাংশে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব আরোপ করা হয়। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকারপদ্ধতি আবার ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অনেকাংশেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবেই আমাদের দেশে অনেকটা ‘রাজকীয়’ প্রধানমন্ত্রীর শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এমন ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীর আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ থাকলে তাঁর পক্ষে স্বৈরাচার হওয়া এবং তাঁর হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে তিনি প্রকৃতপক্ষে প্রভুতে পরিণত হন। এমনই পরিস্থিতিতে আশপাশের ব্যক্তিরাও তাঁর প্রতি সীমাহীন আনুগত্য প্রদর্শন করতে বাধ্য হন এবং অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েন। প্রসঙ্গত, এমন প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদে সীমিত করার প্রস্তাব বিএনপির ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতার আরেকটি উৎস হলো তাঁর একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের পদে আসীন থাকা। শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বাস্তব সমস্যার দিক থেকেই নয়, একই ব্যক্তির একাধারে এই তিন পদ ধারণ করার আইনগত জটিলতাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের প্রধান আর সংসদ নেতা সংসদের প্রধান। একই ব্যক্তির এ দুই পদে অধিষ্ঠিত থাকা নিঃসন্দেহে ‘প্রিন্সিপালস অব সেপারেশন অব পাওয়ার্স’ বা ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির পরিপন্থী। উল্লেখ্য, সংসদীয় দলের নেতা আর সংসদ নেতা এক নয়—সংসদীয় পদ্ধতিতে সাধারণত সংসদীয় দলের নেতাই প্রধানমন্ত্রী হন।
প্রধানমন্ত্রীর একই সঙ্গে দলের প্রধানের পদে থাকা আরও বেশি সমস্যাসংকুল। সংজ্ঞাগতভাবে রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটি নাগরিক সমাজের অংশ। আর নাগরিক সমাজের অন্যতম দায়িত্ব হলো নজরদারির ভূমিকা পালন করা, যাতে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ এবং নাগরিকের অধিকার হরণ না হয়। রাজনৈতিক দলও নজরদারির ভূমিকা পালন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে পারে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি খোলাসা করা যেতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পুনরুত্থান
- স্বৈরাচার সরকার