
বন্যায় পানি দূষণ ও পর্যালোচনা
জীবনের জন্য পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি ও স্যানিটেশন, আমাদের ফসল, গবাদি পশু ও শিল্পের জন্য এবং গোটা জীবন যে বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে তা তৈরি এবং টিকিয়ে রাখার জন্য বিশুদ্ধ স্বাদুপানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মানব স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় পানি এবং আধুনিক স্যানিটেশন সেবার সুবিধা মানুষের মৌলিক চাহিদা।
তবে, বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত অবক্ষয় এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর সহজলভ্যতা হ্রাস করছে। প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মানুষ সম্ভাব্য তীব্র জলাবদ্ধতাপূর্ণ অঞ্চলে বাস করে। ২০৫০ সালের মধ্যে, এই সংখ্যা প্রায় ৩ বিলিয়নে পৌঁছতে পারে। অনেক স্বাদুপানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে, আরও দূষিত হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং দারিদ্র্য আরও গভীর করছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে লক্ষ্য ৬ হলো পরিষ্কার পানি। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে লক্ষ্য ৬ অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে নানা কারণে বিশুদ্ধ পানি দূষিত হয়। আর এই দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় বন্যার সময়।
প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যা কবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮,৪৪,০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বাৎসরিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১৮৭,০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।
ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নদী ব্যবস্থাপনার ওপর। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ফেনী ও নোয়াখালীসহ দেশের এগারো জেলার ৭৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়।
বন্যা পরিবেশের জন্য উপকারের পাশাপাশি ক্ষতিও বয়ে আনতে পারে। বন্যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে পলি জমা করে জমিকে উর্বরা করতে পারে। বন্যার পরবর্তী সময়ে ফসল ভালো হয়। বন্যার পানি সেচের জন্য খালগুলোও পুনরায় পূরণ করে থাকে। অন্যদিকে বন্যা খাদ্য উৎস, ঘরবাড়ি এবং পরিবহন সেবার ক্ষতির পাশাপাশি পানিকে ভীষণভাবে দূষিত করে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কৃষির সাথে পাল্লা দিয়ে শিল্পায়নও হয়েছে। এক্ষেত্রে পোশাক শিল্প ও চামড়া শিল্প উল্লেখযোগ্য। এই শিল্পে প্রচুর পানি ব্যবহৃত হয় এবং নির্গত বর্জ্য পানি আশেপাশের নদী ও খাল বিলকে নিয়মিতভাবে দূষিত করছে। এই দূষণ প্রক্রিয়া আরও বেশি ঘটে যখন দেশে বন্যা দেখা দেয়।
বন্যা বাংলাদেশের পানিকে বিষাক্ত মিশ্রণে পরিণত করে। ২০২৪ সালের আগস্টের বন্যায় যখন তিনটি বড় নদীকে তাদের তীরে ঠেলে দেয়, তখন বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাদামি পানি রাস্তাঘাট এবং ধানক্ষেতগুলো ভেঙে ফেলার চেয়েও বেশি কিছু করে। এটি কাঁচা পয়ঃনিষ্কাশন, কারখানার বর্জ্য পদার্থ এবং কৃষির সাথে যুক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সাথেও মিশে গিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে যা কয়েক মাস পরেও কূপ এবং পানির লাইনগুলো আচ্ছন্ন করে রাখে। পানিবাহিত রোগ জীবাণু মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
বাংলাদেশের যেসব এলাকায় পোশাক কারখানা রয়েছে, সেখানকার নদী, হ্রদ এবং ট্যাপের পানিতে বিপজ্জনক মাত্রায় বিষাক্ত ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক বা forever chemicals’ পাওয়া যাচ্ছে, যার কিছু কিছুর সাথে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (Esdo) এবং এনজিওগুলোর একটি নেটওয়ার্ক আইপেনের প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৯ এবং ২০২২ সালে নেওয়া অনেক নমুনায় ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি PFAS (polyfluoroalkyl substances) ছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পানি দূষণ
- বন্যার প্রভাব