
জুন ১৯৭১: জনযুদ্ধের প্রস্তুতি ও খন্দকার মোশতাকদের ষড়যন্ত্র
জুন ১৯৭১। দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ধারণা দিয়েছিল যে, দেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না এবং ঢাকা শহরও সম্পূর্ণ শান্ত। কিন্তু ওই ধারণা পাল্টে দিয়ে সারাবিশ্বে খবরে জায়গা করে নেয় ঢাকার গেরিলারা। তারা গ্রেনেড চার্জ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
ঢাকার ভেতরে প্রথম ওই অপারেশনটিতে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম (বীরপ্রতীক), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম), বাদল, স্বপন ও জিয়া।
‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হিট অ্যান্ড রান’ নামক ওই অপারেশনটির আদ্যোপান্ত শুনি বীরপ্রতীক হাবিবুল আলমের মুখে। তিনি বললেন যেভাবে, “খবর ছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম ও ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান এসে উঠবেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। পাকিস্তান সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে এবং তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। টার্গেট ছিল ওই ধারণাটাই পাল্টে দেওয়ার। জানানো যে, ঢাকা শান্ত নয় এবং পাকিস্তানি সেনাদেরও নিয়ন্ত্রণে নেই।
৯ জুন, ১৯৭১। সিদ্ধেশ্বরীতে বাদল ভাইয়ের বাড়ি থেকে শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে যাব। রওনা দেই মাগরিবের ঠিক আগে। হোটেলের সামনে এখন যে ভাস্কর্যটা আছে সেখানে ছিল একটা বড় গাছ। প্রেসিডেন্ট ভবন (বর্তমান সুগন্ধা) পেছনে ফেলে ওই গাছটির সামনে আসি। আমরা কিন্তু জানি না তারা কখন আসবে। তারা ভেতরে নাকি বাইরে তাও জানা নেই।
হঠাৎ সাইরেন বাজার শব্দ পাই। দেখি পুলিশের এসকর্ট গাড়ি ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে। পেছনে পুলিশের আরও দুই-তিনটি গাড়ি। শেষে একটি বা দুটো সাদা শেভ্রোলেট গাড়ি নজরে এলো। বুঝে যাই ওই গাড়িতেই রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের অতিথিরা। গাড়িগুলো আমাদের পাশ দিয়েই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢোকে।
আমরা বাইরে। মেইন রোডে হোটেলের ছোট গেটে এসে আমাদের গাড়ি থামে। দেখি দেওয়ালের ওপরে অনেক মানুষের ভিড়। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিচ্ছে তারা। কিন্তু কেউই আমাদের দিকে খেয়াল করল না।
বাদল ভাইকে বললাম আপনি গাড়ি স্টার্ট করেই রাখেন। স্বপন বের হলো, আমি বাঁ পাশ ও মায়া ডান পাশ থেকে বের হলাম। জিয়াও বের হয়ে আসে। জিয়া, মায়া ও আমার কাছে গ্রেনেড। পিস্তল ছিল স্বপনের কাছে। আমি গ্রেনেডের পিন খুলতেই দেখি জিয়া তার হাতের একটি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে। সাদা শেভ্রোলেট গাড়িটি উল্টে গেল। আমি দ্বিতীয় গ্রেনেড আর মায়া ছুড়ল তৃতীয় গ্রেনেডটি। এর মধ্যে জিয়া তার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি সদরুদ্দিনের গাড়ির ওপরে ছুড়ে দেয়।
গ্রেনেডটি গাড়ির পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিস্ফোরিত হয়। দেখলাম গাড়ির পেছন দিকটা একটু ওপরে উঠেই আবার নিচে পড়ে গেল। মায়া আরেকটি গ্রেনেড ছোড়ে, কিন্তু সেটা হোটেলের প্রবেশ পথে গিয়ে পড়ে।