
একাত্তর, অমীমাংসা ও আইন-৩: গণমাধ্যমের দায় ও মীমাংসার খোঁজ
জনগণের পারসেপশন কিংবা এন্টিসিপেশন এক বিষয়। আর গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে তা আরেক বিষয়। সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ীই গণমাধ্যম কোনো বিষয়ে বিমূর্ত কল্পনা বা পূর্বানুমান ধরে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে না। করলেও তাতে সংশয়চিহ্ন বা প্রশ্নচিহ্ন রাখতে হয়। সাংবাদিকদের মতাদর্শ দূরে রেখে ঘটনাকে ‘অ্যাজ ইট ইজ’ বর্ণনা করতে হয়। সেটাই হলো বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। বস্তুনিষ্ঠতার পেছনে না ছুটলে ‘বায়াসড’ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং সেই বিচ্যুতির কারণে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র প্রভাব সচল হয়ে ওঠে।
এই লেখার শেষ পর্বে আমরা চলমান বিতর্কে গণমাধ্যমের দায় ও ভূমিকার ব্যাপারে অনুসন্ধান করব। একই সঙ্গে, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মতামত তুলে ধরে চলমান অমীমাংসা থেকে একটা মীমাংসার খোঁজ করতে চাইব।
বিমূর্ত কল্পনা কিংবা পূর্বানুমান: গণমাধ্যম কি ‘বায়াসড’ হতে পারে?
জামুকা সংক্রান্ত এই অধ্যাদেশ যে বিতর্কিত হয়ে উঠল, তার অন্যতম কারণ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে দায় দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশের কতিপয় সংবাদমাধ্যম (অর্থাৎ সবাই নয়) এই অধ্যাদেশের ব্যাখ্যা এমনভাবে হাজির করেছে, যা থেকে মানুষ ভড়কে গিয়ে সত্যই মনে করেছে বঙ্গবন্ধুসহ চারশতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বোধ হয় কেড়ে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার! আর বিভ্রান্তি ও বিতর্ক যা ছড়ানোর তা এতটাই দ্রুতলয়ে ঘটেছে যে, দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ‘কল্যাণে’ বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।
তবে, অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জামুকা সংক্রান্ত এই অধ্যাদেশের ব্যাপারে হুট করেই সংবাদমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করছে না। গুগলের সূত্র বলছে, দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত অধ্যাদেশ যখন খসড়া আকারে ছিল, তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে এবং প্রায় সবগুলোই লিখেছে যে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। তখন এ বিষয়ে বিতর্ক তো দূরের কথা, তেমন আলোচনাও সর্বমহলে হয়নি।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে দৈনিক কালের কণ্ঠ ‘বদলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা!’ শিরোনামে তাদের প্রধান সংবাদ প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের প্রকাশিত মন্তব্য ছিল, ‘জামুকার আইনে অ্যাবসুলেটলি কিছু দলীয় ন্যারেটিভ আছে। এটা নৈর্ব্যক্তিক একটা অবস্থান থেকে হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। রণাঙ্গনে সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন যারা, তাঁরা চান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হতে। আর মুক্তিযুদ্ধে নানান সহায়ক শক্তি ছিল। ওখানে (মুক্তিযোদ্ধার বিদ্যমান সংজ্ঞায়) ঢালাওভাবে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় নিয়ে আসা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সে জন্য আমরা যারা যেভাবে ভূমিকা রেখেছেন ওইভাবেই উল্লেখ করতে চাই।’
কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্নার মন্তব্যও প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আইনটা দেখে পরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাই, এখনই নয়। তবে, আমি বিশ্বাস করি, রাজাকারসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র ছিল না। তা না হলে সাড়ে চার কোটি মানুষই হাতে অস্ত্র তুলে নিত। যুদ্ধ সহায়করাও মুক্তিযোদ্ধা।’
গত ২১ মার্চ দৈনিক সমকালের অন্যতম প্রধান শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার’। প্রতিবেদনটি তারা প্রকাশ করে অধ্যাদেশের চূড়ান্ত খসড়ার ওপর ভিত্তি করে। ওই প্রতিবেদনে ইমিরেটাস অধ্যাপক ও দেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্যও প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ইতিহাসের সত্যটা জানি। কোনো আইন বদল করে কারও অবদান বদলে দেওয়া যাবে না। এটি করার প্রয়োজন নেই। এগুলো অপ্রয়োজনীয়, অপচয়মূলক কাজ।’
এছাড়া, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামালের মন্তব্যও আছে ওই প্রতিবেদনে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু একটি কনভেনশনাল সামরিক যুদ্ধ ছিল না। একই সঙ্গে এর অন্যতম মূল অংশ ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক। সেই সময়কার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুলত্রুটি সংশোধন অবশ্যই কাম্য। তবে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন এমএনএ বা এমপিএ, গণপরিষদ সদস্যসহ সবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় বাতিল করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণমাধ্যম
- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ