প্রতি বছরই বাজেট দেওয়ার আগে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা থাকে। তবে কোনো বাজেটই জনপ্রত্যাশার পুরোটা মেটাতে পারেনি। কোনো কোনো বাজেট প্রত্যাশার কিছুটা মেটায়, কোনো কোনো বছরের বাজেট মানুষকে হতাশ করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ সালের বাজেট জনপ্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে?
প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। ২০২৫ সালের বাজেটটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বাজেট। নির্বাচিত সরকারের পেশকৃত বাজেটে থাকে দেশের মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দর্শন ও লক্ষ্যের মাঝে প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা।
নির্বাচিত সরকারের প্রতিটি বাজেটই উপযুক্ত পরিকল্পনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে খণ্ডচিত্র থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেওয়া বাজেটে সে সুযোগ নেই। সুতরাং এ বছরের বাজেটের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে এই বাস্তবতাটি মনে রাখা দরকার।
সেই নিরিখে বলা প্রয়োজন যে, ২০২৫-২৬ সালের বাজেটের ক্ষেত্রে কোনো জনপ্রত্যাশা ছিল না যে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি পথনির্দেশনা দেবে। বরং মানুষের আলোচনার বিষয় ছিল যে, এ বাজেট উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির নানান ভঙ্গুর বিষয় ঠিক করে দিতে প্রয়াসী হবে।
জনগণ এটাও জানতো যে, দেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা, অন্তরায় ও সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের বাজেটের কাছে উচ্চাভিলাষ প্রত্যাশিত নয়। এ বাজেট একটি স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরবে। আমি মনে করি যে, মানুষের এসব প্রত্যাশা বর্তমান বাজেট পূরণ করেছে।
তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে, বর্তমান বছরের বাজেটের মনোযোগ স্বল্পমেয়াদি হলেও বাজেটের একটি সুস্পষ্ট উন্নয়ন দর্শন থাকবে এবং সে উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে জনগণ। কিন্তু বাজেটের উন্নয়ন ব্যয় কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে বাজেটে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে ততটা নয়।
সুতরাং এ বছরের উন্নয়ন ব্যয়ের ২৬ শতাংশ যেখানে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্মিলিত বরাদ্দ ২০ শতাংশ। সেই সঙ্গে বাজেটে শিক্ষায় উন্নয়ন বরাদ্দ ৯ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যখাতে ১৮ শতাংশ কেটে দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এখানে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ দর্শনকে কি মানব উন্নয়ন দর্শনের ওপরে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে? কোন উন্নয়ন দর্শন বর্তমান বাজেটের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে, তার সুস্পষ্ট প্রকাশ বাজেটে থাকা উচিত ছিল। সেই অস্পষ্টতা আমাদের হতাশ করেছে।
দেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় তিনটা সমস্যা অত্যন্ত প্রকট-অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি, বিনিয়োগের বিশাল ঘাটতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি কথা প্রাসঙ্গিক।
প্রথমত: বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৩.৯৭ শতাংশ, কোভিড কাল বাদ দিলে, ৩৪ বছরের মধ্যে নিম্নতম। অথচ বর্তমান বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। এ প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান বিনিয়োগ হার দশ বছরের মধ্য নিন্মতম। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও তেমন আসছে না। বিনিয়োগের শ্লথ গতি ইতিমধ্যেই কৃষি এবং সেবা খাতকে আরও সঙ্কুচিত করবে, খাতওয়ারি ও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করবে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে, বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকবে। তার অনুপস্থিতি আমাদের হতাশ করেছে।