ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা, ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি, এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ, টানা তিন অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ে ঘোষণা হলো ২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট। কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি এখন গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গণ-অভ্যুত্থানের পর গেল বছরের ৮ আগস্ট শপথ নেয়া সরকারটিকে নিদারুণ এক বাস্তবতায় বাজেট দিতে হয়েছে মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে। বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতি ও কাঠামো নিয়ে অনেক দিন ধরে চলা সমালোচনা থাকলেও প্রথার বাইরে যাওয়া হলো না।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে সেই কাজটা কিছুটা করতে পারতো। কারণ দেশ সেরা অর্থনীতিবিদরা আছেন তার সরকারে বা সরকারের সাথে। অর্থনীতির নামকরা শিক্ষক রয়েছেন বেশ কয়েকজন। অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সালেহউদ্দীন আহমেদ, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যরা এ সরকারের হার্ডকোরের ব্যক্তি। রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। নোবেল লরিয়েট প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস তো নিজেই অর্থনীতির বিশ্বতারকা।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর এটা প্রথম বাজেট। নির্বাচনের যে তাড়া তাতে এটাই সম্ভবত এ সরকারের শেষ বাজেটও। নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানোসহ বহু ছড়ানো ছিটানো কাজের কারণে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতি হয়ে গেছে বেশি মুখ্য। দলীয় সরকারগুলো যে বাজেট দেয়, তার বাইরে বেরিয়ে একটা বৈষম্যবিরোধী, উন্নয়নমুখী বাজেট দেয়ার উদাহরণ তৈরির সুযোগ পেলো না অর্থনীতির অ্যাকাডেমিক বিশারদদের সরকার। নিতে পারেনি আয়-রোজগার, বিত্ত-বৈভব, কর্মসংস্থানে বৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ। অথচ বৈষম্যের অবসান ঘটানোর আন্দোলন দিয়েই গেল সরকারের করুণ বিদায় এবং এ সরকারের অভিষেক।
টানা তিন বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রভাবের পাশাপাশি গত প্রায় এক বছরের বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি অর্থনীতির সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সন্ত্রাসের মতো ঘটনার কারণে বেসরকারি খাত হাবুডুবু খাচ্ছে। বিনিয়োগ কমে চলে গেছে তলানিতে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় টানা ৩৯ মাস ধরে কম, ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্মসংস্থান কমে গেছে। মিলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাঁটাইয়ের ফলে চলতি বেকারের সঙ্গে যোগ হয়েছে লাখ খানেক কর্মহারা নতুন বেকার।
এ রকম এক পরিস্থিতিতেই পেশ হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি মেনে ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে বাজেট বাস্তবায়নে সরকার সময় পাবে ছয় মাস। আর প্রধান উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী জুনে নির্বাচন হলে এক বছর। অর্থনীতির জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে মোট বিনিয়োগ ও মোট দেশজ সঞ্চয়। দুটোই কমে গেছে। এবার মোট বিনিয়োগের হার হচ্ছে জিডিপির ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর আগে এর তুলনায় কম বিনিয়োগের অর্থবছর ছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছর, ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর মোট দেশজ সঞ্চয় তো কমছে ধারাবাহিকভাবে।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশে মোট দেশজ সঞ্চয় কমে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক সংকেত, যার প্রভাব বহুমাত্রিক। বেসরকারি খাকে ঋণ কমে যাওয়া হচ্ছে আরেকটি দুশ্চিন্তার সূচক। এ খাতে বৃদ্ধির হার হচ্ছে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টানা পাঁচ মাস ধরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের কম থাকার কোনো তথ্য বাংলাদেশে নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানি সংকট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে। তারওপর ছোট-বড় বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক কারণে। সেখানকার হাহাকার জানেন কেবল ভুক্তভোগীরা।