
সংকটের সমাধান রাজনৈতিক পথেই
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সরকার পরিচালনায় নানা ধরনের অসহযোগিতার মুখে কাজ করতে না পারায় হতাশাবোধ থেকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চান। তিনি আরেকটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিদায় নিতে চান।
রাজনীতির পরিসরে কিছুদিন ধরে যে অস্থিরতা চলছিল, তাঁর এই কথিত পদত্যাগের সম্ভাবনায় তা আরও বহুগুণে ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু কোন পটভূমিতে এই পদত্যাগের গুঞ্জন?
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের সময় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবি, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তার জন্য কথিত করিডর প্রদানের প্রশ্ন, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর অসন্তোষ নিয়ে যখন অস্বস্তি বাড়ছে, তখন এসব বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের কথিত কিছু বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বুধবার ২১ মে সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে যে সভা করেন, সেখানে নির্বাচন, করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন বলে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, স্পষ্টতই তাতে সরকারের মতামতের প্রতিফলন ছিল না।
সেনাপ্রধান ওই সভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হওয়া বা মব সৃষ্টির বিরুদ্ধেও কথা বলেন। অথচ ২০ তারিখ রাতে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি বৈঠক হয়েছিল এবং তাতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। সেনা সদরে অনুষ্ঠিত সভায় সেনাপ্রধানের বক্তব্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা যথার্থ ছিল না—এমন কোনো দাবি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে করা হয়নি। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বলেই সরকারের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সেনানিবাসে সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধানের বক্তব্য স্বাভাবিক সময়ে সংবাদপত্রের পাতায় বড় শিরোনাম হওয়ার কথা নয়। সেনাশাসনের সময়ে অবশ্য এটি নিয়মিতই ঘটত। কেননা, তখন সেনাশাসকের পক্ষে যে সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ আছে, সেটা প্রমাণ করা তাঁর জন্য জরুরি ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার সাময়িক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, সেই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতেও সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রতি সবার বাড়তি আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি বর্তমানে গুজবের যে সুনামি চলছে, তার পটভূমিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
২১ মে সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে যখন সভা করেন, সেই একই দিনে ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্তত ২৪টি ভুয়া তথ্য খণ্ডন করেছে। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রধান উপদেষ্টাকে ক্ষমতাচ্যুত করা, সেনাপ্রধানকে অপসারণ ও গ্রেপ্তার করার মতো ভুয়া তথ্য। স্পষ্টতই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকেরা নানাভাবে দেশে যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে, এগুলো তারই অংশ। তবে দেশের ভেতরেও যে একাধিক গোষ্ঠী একই রকম চেষ্টায় জড়িয়ে পড়েছে, এমন সন্দেহও প্রবল।
এ রকম স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্যের নানা ধরনের ব্যাখ্যা তৈরি হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
কিছুদিন ধরেই দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিজেদের মধ্যে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কিছু বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক ও টানাপোড়েন চলছে। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রধান প্রধান শক্তির মধ্যেই অবিশ্বাস ও রেষারেষি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির কিছু নেতা দুজন ছাত্র উপদেষ্টা—মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছেন।
এর পাল্টা হিসেবে ছাত্রদের তৈরি নতুন দল এনসিপি অন্য তিনজন উপদেষ্টা—সালেহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিএনপির প্রতিনিধি অভিহিত করে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এ ধরনের বিরোধ যখন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তখনই সেনাপ্রধানের এসব বক্তব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক অস্থিরতা
- সংকট সমাধান