
ভারতের যুদ্ধ-রাজনীতি কি অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা?
পেহেলগামের মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার রক্তাক্ত অভিঘাতে যখন সমগ্র ভারত স্তব্ধ, ঠিক ওই সময় দিল্লি থেকে ঘোষিত হলো ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারতে দাবি, সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিতে তাদের নিশানা করা হামলাটি আপাতদৃষ্টিতে ছিল সীমিত ও কৌশলগত। কিন্তু এই সীমিত হামলার আড়ালেই যেন লুকিয়ে রয়েছে এক বহুমাত্রিক সংকটের ইঙ্গিত। কারণ, প্রশ্ন কেবল প্রতিক্রিয়ার মাত্রা নয়, প্রশ্ন ভারত কেন এই প্রতিক্রিয়ার পথ বেছে নিল এবং ভবিষ্যতে তার পরিণতি কী হতে পারে।
সর্বশেষ খবর অবশ্য বলছে, চুক্তির টেবিলে বসে যুদ্ধবিরতিতে গিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। পাল্টাপাল্টি হামলার চার দিনের মাথায় শনিবার বিকাল থেকে এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় সংঘাতের ‘আপাতত’ ইতি ঘটেছে। তবে এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও দুই দেশের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। অস্ত্রবিরতি ঘোষণার পর শ্রীনগরে বিস্ফোরণের অভিযোগ এনেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পোস্টে আব্দুল্লাহ বলেন, “যুদ্ধবিরতির কী হল? শ্রীনগরজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।”
যুদ্ধ হয়তো থামবে অচিরেই। তবে যে কোনো যুদ্ধের পেছনে শাসকদের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ থাকে। এই যুদ্ধের পেছনেও আছে। তবে সাদা চোখেই দেখা যায়, সম্প্রতি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তির নয়। মণিপুরে দীর্ঘমেয়াদী জাতিগত সহিংসতা, পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলনের অব্যাহত ক্ষোভ, পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি জাতীয় রাজনীতিতে সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার চাপ— সবকিছু মিলিয়ে কেন্দ্রীয় শাসকের সামনে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।
ইতিহাস বলছে, অনেক সময় সরকার অভ্যন্তরীণ চাপ হালকা করতে বাহ্যিক শত্রু তৈরি করে; যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাত তখন হয়ে ওঠে এক জাতীয়তাবাদের ‘উদ্দীপক’— যা ক্ষণিকের জন্য হলেও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। অতএব, অপারেশন সিঁদুরের পেছনে যে রাজনৈতিক লাভের আশঙ্কা নেই, তা বলা যায় না।
কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল যতই জোরাল হোক না কেন, যুদ্ধের অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে কোনো রাষ্ট্রই মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না। গত এক দশকে ভারতের অর্থনীতি উচ্চবৃদ্ধির পথ পেরিয়ে এখন এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী, কৃষিখাতের অস্থিরতা অব্যাহত, শিল্পোৎপাদনে মন্দার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে এবং রাজস্ব ঘাটতি চাপ সৃষ্টি করছে সরকারের ওপর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও শুল্কনীতিতে মতবিরোধ চলছে, চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সীমান্ত উত্তেজনা এবং বাণিজ্যিক বৈরিতা স্পষ্ট। এমন প্রেক্ষাপটে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করা মানে শুধুই আর্থিক আত্মঘাত।
পাকিস্তানকে এই যুদ্ধে অবহেলার চোখে দেখা হবে এক মারাত্মক কৌশলগত ভুল। রাজনৈতিকভাবে নাজুক, অর্থনৈতিকভাবে কার্যত দেউলিয়া ও বিদেশি ঋণে বিপর্যস্ত হলেও, পাকিস্তান সামরিক দিক থেকে বেশ সবল। সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের, কিন্তু ওই দ্বন্দ্বই কোনো বহিরাগত হুমকির মুখে আচমকা ‘জাতীয় একতা’র মোড়কে গলে যেতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- যুদ্ধ ও সংঘাত