
উলবাকিয়া কি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম?
ডেঙ্গু (Dengue) একটি মারাত্মক মশাবাহিত রোগ যা বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে, ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া (Wolbachia Bacteria) ব্যবহার করে মশা দমনের পদ্ধতি একটি সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে আনার জন্য নানা ধরনের কার্যক্রম ও প্রচারণা চলছে।
নতুন একটি প্রযুক্তি বাংলাদেশে আনার পূর্বে এর সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান এবং এটি কতটা সফলতা এনে দেবে তা নিয়ে অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে মশার আদ্যোপান্ত নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে উলবাকিয়া প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, ঢাকা শহরে এর কার্যকারিতা, সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবায়নের খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন বোধ করি।
উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া: বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
উলবাকিয়া (Wolbachia) হলো একটি প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া যা পৃথিবীর ৬০ শতাংশ পোকামাকড়ের দেহে বসবাস করে। এটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, তবে এটি মশার প্রজনন ক্ষমতা এবং ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করা ক্ষমতা নষ্ট করতে সক্ষম। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, উলবাকিয়া-আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টাই মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি করতে অক্ষম। এই ব্যাকটেরিয়া মশার ডিমের বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করে, ফলে মশার সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
উলবাকিয়া (Wolbachia) ব্যাকটেরিয়া পুরুষ মশার পুরুষত্ব নষ্ট করে বন্ধ্যা করে দেয়। এই ব্যাকটেরিয়া শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির এডিস মশার সংখ্যা কমাবে অন্য প্রজাতির মশার ক্ষেত্রে এটি কোনো ভূমিকা রাখবে না। উলবাকিয়া বহনকারী মশা ছেড়ে দেওয়া বন্ধ করে দিলে সেই এলাকাতে ধীরে ধীরে মশার সংখ্যা আবার স্বাভাবিক স্তরে ফিরে আসবে।
প্রযুক্তির প্রয়োগ পদ্ধতি
উলবাকিয়া প্রযুক্তির (Wolbachia Technology) প্রয়োগ শুরু হয় ল্যাবরেটরিতে এডিস মশার কলোনি তৈরি করে, যেখানে বিশেষ পদ্ধতিতে মশার ডিমে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো হয়। ডিম ফুটে বের হওয়া মশাগুলো থেকে শুধুমাত্র পুরুষ মশাগুলো বাছাই করে ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় নিয়মিতভাবে মুক্ত করা হয়। প্রকৃতিতে থাকা স্ত্রী মশার সাথে যখন এই উলবাকিয়া-আক্রান্ত বন্ধ্যা পুরুষ মশা মিলিত হয়, তখন সৃষ্ট ডিম থেকে মশার লার্ভা তৈরি হয় না, ফলে মশার সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
একইসাথে, উলবাকিয়া-আক্রান্ত স্ত্রী মশাগুলো ডেঙ্গু ভাইরাস বহন ও সংক্রমণ করতে অক্ষম হয়, যা ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়ার সাফল্য নিশ্চিত করতে প্রতি সপ্তাহে বিপুল সংখ্যক উলবাকিয়া-আক্রান্ত পুরুষ মশা মুক্ত করতে হয় এবং ফলাফল পর্যবেক্ষণের জন্য এলাকাভিত্তিক মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু সংক্রমণের হার নিয়মিত মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
উলবাকিয়া পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিনা?
এটি যেহেতু প্রকৃতিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং প্রকৃতিতে সাধারণভাবেই এটি পাওয়া যায় তাই এই ব্যাকটেরিয়াটি দ্বারা পরিবেশ প্রকৃতির কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তারপরও এটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। মানব স্বাস্থ্যের জন্য এটি ক্ষতিকর কিনা তারও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এই বিষয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
ঢাকা শহরে উলবাকিয়া প্রযুক্তির কার্যকারিতা
ঢাকা শহরে উলবাকিয়া প্রযুক্তির সাফল্য নির্ভর করবে শহরের অনন্য চ্যালেঞ্জগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এর বাস্তবায়ন কৌশলের ওপর - উচ্চ জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ব্যাপক মশার প্রজননস্থল (যেমন নির্মাণাধীন স্থানের পাত্রে জমে থাকা পানি, বহুতল ভবনের পার্কিংয়ে জমা পানি, ছোট বড় অসংখ্য পাত্র) এই প্রযুক্তির কার্যকারিতাকে জটিল করে তোলে।
তবে, ইন্দোনেশিয়ার ইয়োগিয়াকার্তার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এই পদ্ধতি ৭৭ শতাংশ ডেঙ্গু হ্রাসের সাফল্য দেখিয়েছে বলে কোম্পানিগুলো জানাচ্ছে। এই প্রযুক্তির মূল চাবিকাঠি হলো চিহ্নিত জায়গায় প্রচুর পরিমাণে মশা ছেড়ে দেওয়া। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ নগরীতে উলবাকিয়া প্রযুক্তি কার্যকর করতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান এডিস মশার চেয়ে ৫-১০ গুণ বেশি উলবাকিয়া-আক্রান্ত পুরুষ মশা নিয়মিত ছাড়তে হবে।