
নববর্ষের আগাম সুখবার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদাকে জানাই অসীম কৃতজ্ঞতা। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের মার্কিন স্বীকৃতি মিলেছে তাঁর কারণে। এটি আমাদের অর্জন। এ বছরের ২২ জানুয়ারি সর্বসম্মতভাবে তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। বাংলা নববর্ষের এই স্বীকৃতি ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা থাকবে।
কিন্তু আমাদের দেশে মূল ভূখণ্ডে কি ভালো আছে, নিরাপদ আছে নববর্ষ? মনে হয় না। একটা গোষ্ঠী নববর্ষের গায়ে দাগ লাগাতে চাইছে। বরাবরই চায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমরা আর আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নই। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে—আমরা কি হীনবল হয়ে পড়েছি? আমাদের সব অর্জন কি তাহলে শেষ হতে চলেছে?
আমি মনে করি এখনো বাংলা নববর্ষ পারে আমাদের জাগিয়ে রাখতে। রাজনীতি না হলেও এই উৎসব সামাজিক রাজনীতির এক বিরাট অংশ। এর সঙ্গে আনন্দ উৎসব আর আচারের যোগ নিবিড়। নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন অহংকার। তারপরও প্রতিটি দিবস নিয়ে আছে মতভেদ। কথা ছিল একাত্তরে মীমাংসিত এই বিষয়গুলো নিয়ে আর কোনো দিন কোনো কথা উঠবে না। তা কি হয়েছে? বরং যত সময় গেছে তত দিবসগুলো নিয়ে তর্ক আর ঝগড়া বেড়েছে। শুধু বাংলা নববর্ষের দিনটিই ছিল অপরিবর্তিত, যার ওপর আঁচড় পড়েনি। কিন্তু এবার কি সেই আঁচড় পড়তে যাচ্ছে?
বাংলা নববর্ষ কোনো সাম্প্রদায়িক উৎসব নয়। বরং এর পরতে পরতে আছে বাঙালির প্রাণস্পন্দন। ইতিহাস বলছে, সৌরপঞ্জিমতে বাংলায় ১২টি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় এ সৌরবছর গণনা শুরু হতো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যেত না। আর তখনই সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরবছর ও আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এ গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত পঞ্জিকা অনুসারে এ দিনটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিষ্টীয় সালের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। তা হলো হিজরি সন চলে চাঁদের সঙ্গে আর খ্রিষ্টীয় সাল চলে ঘড়ির সঙ্গে। এ কারণে হিজরি সনের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনের মধ্য দিয়ে, ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে আর বাংলা তারিখ শুরু হয় ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের একটি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেসকো স্বীকৃত। ইউনেসকো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরও যে কয়েকটি কারণ ইউনেসকো উল্লেখ করেছে, তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলা নববর্ষ
- নববর্ষ উদযাপন