
ইউএসএআইডির সহায়তা স্থগিতে উন্নয়নকর্মীরা কেমন আছেন
বিশ্বায়নের যুগে আমরা কাজ করি একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে। শুধু নিজের উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিতভাবেই একান্ত নয়, আমাদের এই আশপাশের সবাইকে নিয়ে এখন চলতে হয়। মনে করছেন, আপনি ভালো আছেন, তাই আর কোনো সমস্যা নেই? নিজেদের ভালো রাখার পাশাপাশি আপনাকে আপনার সঙ্গে যুক্ত সব পর্যায়ের উপকারভোগীদের নিয়ে এগোতে হবে।
এই ধারণা যে কতটা সত্যি, তার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে অতি সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্বব্যাপী নাড়া দেওয়া একটি ঘোষণা—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০০টি অধ্যাদেশ বাতিলের ঘোষণা। তার মধ্যে অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের করের টাকায় ব্যয়িত ইউএসএআইডির পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম। এর ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও একটা বিরাট অংশ হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে পড়ে গেছে।
শুধু উপকারভোগীরা নন, এর সঙ্গে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের আনুমানিক লক্ষাধিক উন্নয়নকর্মী বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই চাকরি হারিয়েছেন। যাঁরা এত দিন অন্যের জন্য জীবন সহজ করতে নানা সাহায্য–সহযোগিতা নিয়ে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের কী অবস্থা? সবাই ভাবছেন, বড় অঙ্কের বেতনভুক্ত এসব কর্মকাণ্ড যুক্ত ব্যক্তিরা অনেক অর্থসম্পদ জমিয়ে বেশ একটা আরামদায়ক জীবন যাপন করছেন। আসলে ঘটনা কি তা–ই? তাঁরা কেমন আছেন, এর একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই।
কেস স্টাডি–১
মিথিলা (ছদ্মনাম) একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে প্রথম থেকেই উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। যেহেতু বেতনের অঙ্কটা ছিল আশানুরূপ, তাই জীবনের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের গর্বিত মালিক হয়েছেন। নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ততা এসেছে। সন্তানের ভাগ্য গড়ে দিতে ভর্তি করিয়েছেন নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে। স্বামীর আয়ও মন্দ নয়। এই পর্যন্ত সব ঠিক চলছিল মাসের বেতন ঘরে ঢুকলে সহজেই জমা করতেন এই বিলাসবহুল জীবনের জন্য করা ব্যাংকের ঋণের মাসিক কিস্তি। বাচ্চাদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বিধি বাম, ২৪ জানুয়ারি, ২৫ ইউএসএআইডির বিশ্বব্যাপী ফান্ড বন্ধের ঘোষণা এলে একপলকে পৃথিবীর সব আলো কেড়ে নিল এই পরিবার থেকে। যেটা কখনো এই সুখী পরিবার কল্পনাও করতে পারেনি ঘুণাক্ষরেও! পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ স্থগিত ঘোষণা যখন স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ঘোষণা এল, তখন এই নারীর চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকল না। আজীবন কর্মসূত্রে যেসব মানুষের জন্য এই মানুষটি নিজেকে নিয়ে চিন্তা না করে কাজ করেছেন, তাঁরা আজ অন্য সহযোগিতার আশ্বাস নিয়ে এখন আর মিথিলা আপার খবর রাখেন না।
কেস স্টাডি–২
রহমান সাহেব (ছদ্মনাম) দীর্ঘ মেয়াদে নতুন প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইতিমধ্যেই কর্মস্থলে বাসা ভাড়া নিয়ে থিতু হতে চেয়েছিলেন। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ কীভাবে সহজ করতে পারেন ভেবে জানুয়ারি মাসে বাচ্চাদের ভালো বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে একটা যথাযথ পরিকল্পনা করেছিলেন। নিজের পরিবারের জন্য অনেক কিছু করতে চেয়েছিলেন। যাঁরা উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত, তাঁরা তাঁদের উপকারভোগীদের পরিকল্পনা করার পাশাপাশি নিজ পরিবারের জন্য নিশ্চিত ভালো থাকার নানা আয়োজন করে ফেলেন চিন্তাভাবনা করে। রহমান সাহেব তার থেকে ভিন্ন ছিলেন না। কিন্তু ইউএসএআইডির সহায়তা বন্ধের ঘোষণা সব এলোমেলো করে দিয়ে তাঁদের ঠেলে দিল এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে আশাবাদী মানুষ এখন দেশব্যাপী সংখ্যায় একদম কম নয়।
যাঁরা শুধু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, তাঁদের জীবন এখন কেমন চলছে, কেউ খোঁজ রাখে না। রোজার মাস কীভাবে অতিবাহিত করছেন, তার খবর কেউ জানেন না। পবিত্র ঈদের আয়োজন তাঁদের জন্য কেমন হবে, তা শুধু তাঁরা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছেন চাকরির নানা বিজ্ঞাপন দেখে। অথচ হঠাৎ বিশ্বব্যাপী এই দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে চাকরি আর সহজলভ্য নয় এখন কারও জন্য। দায়িত্বশীলতার জন্য যাঁরা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সফল কর্মকর্তা, তাঁরা এখন পরিবারের সব অসহায়ত্বের ঝুলি মাথায় নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সামাজিকতার বেড়াজালে আটকে এই অসহনীয় জীবনযাপনের কথা বলতে পারছে না কারও কাছে। তাঁদের আশপাশে লোকজন ধরেই নিয়েছেন, তাঁদের আবার সমস্যা কী? এত টাকা আয় করেছেন, নিশ্চয় তাঁরা প্রচুর সম্পদের মালিক! তাঁদের কেন সমস্যা হবে? একবারের জন্য চিন্তা করলে দেখতে পাবেন, যাঁর যেমন আয়, ব্যয়ের পরিমাণ তাঁর সে রকমই থাকে!
কেস স্টাডি ৩
আবদুর রহিম (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। স্বল্প আয়ের এই মানুষটি তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য নিশ্চিত করে চলেছিলেন দৈনন্দিন সব চাহিদা। যদিও মাস যেত বড় হিসাব–নিকাশ করে, তবু চলছিল তাঁদের জীবন। সংসারের প্রয়োজনে তিনি অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য বাকিতে কিনতেন দীর্ঘদিনের পরিচিত এক দোকানির কাছ থেকে। চাইলেই পেয়ে যেতেন আবদুর রহিম। কারণ, মাসের বেতন পেলেই তিনি পাওনা শোধ করে দিতেন। জানুয়ারি মাসে হঠাৎ তাঁর ফান্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর এখন সবাই জানে। লক্ষাধিক মানুষের আয়ের উৎস এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবদুর রহিমসহ যাঁরা এই পর্যায়ে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের এখন কেউ আর বাকিতে কোনো দ্রব্য নিতে নারাজ। কারণ, তাঁদের তো চলতে হবে।
একটা ছোট আশা ছিল, হয়তো রিভিউ হয়ে ফান্ড আবার সচল হবে। কিন্তু সর্বশেষ খবর, বাংলাদেশ এখন থেকে এসব ফান্ড বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম সমাজে পবিত্র রমজান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে যেমন নিজেকে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে নিবেদন করার, তেমনি দিনশেষে পরিবারের সঙ্গে একটু উন্নত খাবার খেয়ে ইফতার করার।
আবদুর রহিমসহ মাঠপর্যায়ের এই কর্মচারীদের এখন পবিত্র রমজানের এ আয়োজন বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিন বেলা পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চাকরি এখন সোনার হরিণ হয়ে গেছে!
এমন সময় একটি মানবিক উদ্যোগ আমাকে নাড়া দিয়েছে। ইহসান নামে একটি উদ্যোগ এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের স্বল্প পরিসরে আয়োজন নিয়ে। অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বলা যায় এ আয়োজন চলছে। তারা ইউএসএআইডির সব বিপর্যস্ত কর্মীর তালিকা আহ্বান করেছিল তাদের ফেসবুক পেজ থেকে। তাঁদের মধ্য থেকে কিছু মানুষের জন্য রমজান প্যাকেজ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। ইহসানের এই কার্যক্রম সহযোগিতা করতে স্বপ্ন সুপারশপ এগিয়ে এসেছে। হয়তো শুরুটা খুব সামান্য, তবে মানুষ মানুষের জন্য, তা আবারও প্রমাণ করতে পেরেছেন এই ইহসান পেজের অ্যাডমিনরা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আর্থিক সহায়তা
- ইউএসএআইডি