
মার্চ ১৯৭১ : পথ খুঁজে খুঁজে দুই দিন
১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে আমাকে আমার দুই কোম্পানি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা (আইএস ডিউটি) রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। ৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার, পিএসসি, উপ-আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক, ইস্টার্ন কমান্ডার সাহেবজাদা ইয়াকুবের টেলিফোনে দেওয়া অনুমোদনক্রমে চট্টগ্রাম শহরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। ক্যাপ্টেন মহসিন সার্কিট হাউসের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পান। আমাকে আমার দায়িত্বের অতিরিক্ত (আমার অফিস তখন নিয়াজ স্টেডিয়ামে, বর্তমানে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম) উপ-আঞ্চলিক প্রশাসকের অফিস পালাক্রমে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দায়িত্ব আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলাম।
২৪ ও ২৫ মার্চ
রাজনীতিতে যেমন, তেমনি সেনাবাহিনীতে আমরা যাঁরা বাঙালি ছিলাম আমাদের মধ্যেও, মার্চের শুরু থেকেই দিনগুলো ছিল খুবই ঘটনাবহুল। আমি এখানে ২৪ ও ২৫ মার্চের কথাই বলব।
২৪ মার্চ ১৯৭১ সালে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বানানো হবে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপসকে শান্ত করার লক্ষ্যে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে দরবার নেওয়ার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে দু-দুটি হেলিকপ্টারে করে ১৭ জন সিনিয়র অফিসার সকাল ৯টায় চট্টগ্রামে উপস্থিত হয়। কনফারেন্সের নামে তারা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঘিরে রাখল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বাথরুমে যাওয়ার নাম করে বাইরে এসে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমাকে তারা ঢাকায় নিয়ে যেতে এসেছে—যদি হুকুম তামিল না করি, তাহলে তা হবে রিভোল্ট। বঙ্গবন্ধুকে নিজে আমাকে হুকুম দিতে হবে—তাড়াতাড়ি যাও শহরে গিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করো।’ বলে উনি বাথরুমে চলে গেলেন। ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টার থেকে কর্নেল তাজ (জি-১ আই) টেলিফোনে বললেন, ক্যাপ্টেন আমীন যেন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তাঁকে আর্মি এভিয়েশনে সিলেক্ট করা হয়েছে এবং করাচিতে পাঠানো হবে।
এদিকে মেজর বেগ নাকি হুকুম জারি করেছেন গাড়ির চাবিগুলো তাঁর কাছে জমা করতে হবে। ধমক দেওয়ায় সিভিল ড্রাইভার সিভিল জিপ গাড়িটি নিয়ে এল। তাঁকে নিয়ে দ্রুত রেলওয়ে কলোনিতে ডিএস মুকবুল আহমেদের বাসায় গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এম আর সিদ্দিকী ঢাকায় আছেন। টেলিফোনে কর্নেল ওসমানীকে না পেয়ে মেসেজ রেখে (হুকুম তামিল করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকায় যাবেন কি যাবেন না) দ্রুত সেনানিবাসে ফিরে এলাম। মুকবুল ভাবি বললেন, ‘কেন যাচ্ছেন?’ বললাম, “ঠিক জানি না। এখন অনেক তাড়া, তাই আর বসতে পারছি না। যদি মেসেজ আসে আমাকে টেলিফোনে শুধু ‘এসেছে’ বলবেন। আমি মেসেজ সংগ্রহ করিয়ে নেব। আম্মা পারলে বাবাকে খবরটা পাঠাবেন যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে।” রুহ আফজার শরবত খেয়ে চলে এলাম।
ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকের কাছেও মেসেজ পাঠালাম—আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অষ্টম বেঙ্গলে মেজর জিয়াকে খবর দিলাম, তিনি যেন হোল্ডিং কোম্পানিতে এসে আমাকে খবর দেন। বিষয়টি জরুরি। তিনি এসেছিলেন এবং ক্যাপ্টেন এনামের মাধ্যমে খবর দিয়েছিলেন। এনাম লাঞ্চের পর বলল, আমীন, মেজর জিয়া বেলা ১১টায় হোল্ডিং কোম্পানিতে তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সকালবেলায় শহরে যাওয়ার আগে দৌড়ে সিএমএইচে অসুস্থ কর্নেল এম আর চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। আপনি অসুস্থ, তবু তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে থাকুন।’ তিনি বললেন, ‘দুই কোম্পানি তৈরি করে রাখো, প্রয়োজনে রেইড করে হলেও ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তাদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে।’ পোর্টে তখন জেনারেল মিঠঠা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে (সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহসীন) সামনে বসিয়ে টেবিল থাবড়িয়ে বলছেন, ‘আনলোড সোয়াত।’
লাঞ্চের সময় কর্নেল জানজুয়া বললেন, ‘আমীন, ডু ইউ সি মাই টুআইসি?’ উত্তরে বললাম, এখানে ইউনিট অধিনায়ক এবং লে. কর্নেল পদবি ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসারদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। টুআইসির আসার কথা নয়। কর্নেল জানজুয়ার সঙ্গে ১৯৬৭-৬৮ সালে জয়দেবপুর ও লাহোরে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে একসঙ্গে চাকরি করেছি। সে সুবাদে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। দেখি, ডিসি মোস্তাফিজুর রহমানও এসেছেন। নায়েক ক্লার্ক মিজান এবং অন্যরা মেসের বাইরে অপেক্ষা করছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে ওরা বলল, ‘স্যার, আপনারা যাবেন না। এদের বিশ্বাস করবেন না। ট্রুপস-কোথ (অস্ত্রাগার) থেকে হাতিয়ার বের করে পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে ফেলেছি। হেলিকপ্টার দুটি মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।’ মেসে তখন সেন্টারের ব্যান্ড মিউজিক বাজছিল। ওরা বলল, ‘ব্যান্ডের সব সৈনিক পোশাকের ভেতর লোডেড অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে—হুকুম দিলে এখান থেকে একজনও জীবিত যেতে পারবে না।’
সংবিৎ ফিরে যখন ওপরে পাহাড়ের দিকে তাকালাম, তাকিয়ে চমকে উঠলাম। পুরো শরীর হিম হয়ে গেল প্রায়। সে সময় মেসে লাঞ্চ করার জন্য জেনারেল জানজুয়া, খোদাদাদ, খাদিম হুসেন রাজা, কমান্ডার মোমতাজ, ব্রিগেডিয়ার আনসারি বাবর, যুদ্ধজাহাজের কমান্ডার আজিমসহ প্রায় ১৭ জন সিনিয়র অফিসার উপস্থিত। বস্তুত জেনারেল টিক্কা খানসহ হাতে গোনা চার-পাঁচজন সিনিয়র অফিসার বাদ দিলে ইস্টার্ন কমান্ডের সংশ্লিষ্ট কমান্ডার তখন চট্টগ্রামে কর্মরত সব সিনিয়র অফিসারসহ (বাঙালি/অবাঙালি) আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করছিলেন।
ঢাকা থেকে আসা হেলিকপ্টার দুটি প্যারেড গ্রাউন্ডে পার্ক করে আছে। অবশ্য দুটি ট্যাংক ইবিআরসির মেইন রাস্তা ও প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে অবস্থান নিয়ে মোটামুটি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাড়ি ও মেসের দিকে ব্যারেল তাক করে আছে। পূর্বাহ্ণে ট্যাংকের বাঙালি ড্রাইভাররা ট্যাংকের ইঞ্জিনের ভেতর বালু ফেলে দিলে ট্যাংক অকেজো হয়ে যাবে বলে আমাদের জানিয়েছিল। সেনানিবাসে তখন মোট তিনটি ট্যাংক ছিল ক্যাপ্টেন কেয়ানির অধীনে (ইবিআরসি মেসে কেয়ানি আমার পাশের রুমেই থাকত। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে কেয়ানি ক্যাপ্টেন এনাম আহম্মদ চৌধুরীকে তাঁর ট্যাংকে পুরে শেরশাহ কলোনি পর্যন্ত এনে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার ভাগো।’ প্রাণে বেঁচে যায় এনাম)।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ