
বিপদের নাম জিকা ও নিপাহ ভাইরাস
ভাইরাস এবং ভাইরাসজনিত জ্বর এই দুটি বিষয়ের সঙ্গেই আমরা পরিচিত। ২০০০ সালের আগে ভাইরাসজনিত জ্বর বলতে আমরা সাধারণ ঠান্ডা জ্বর, ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জাকে বুঝতাম। ভাইরাস শব্দটি বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয় ২০০০ সাল থেকে। কারণ সে বছর দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বরের উপস্থিতি জনমনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বইয়ে দেয়। ডেঙ্গু শুরুর ২০ বছর পর কোভিড-১৯-র বৈশ্বিক মহামারি ভাইরাস শব্দটির সাথে আতঙ্কের নতুন মাত্রা যোগ করে। সম্প্রতি দুটি ভাইরাসজনিত জ্বর নতুন করে আমাদের চিন্তা ও আশঙ্কার উদ্রেক ঘটিয়েছে। এই ভাইরাস দুটি হচ্ছে জিকা ও নিপাহ।
জিকা ভাইরাস: সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে দেশে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ২০২৩ সালে ১৫২ জন জ্বরের রোগীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ২০২৫ সালে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায় ১৫২ জনের মধ্যে ৫ জনের শরীরে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি। এই ৫ জনই এক কিলোমিটার এলাকার ভেতর বসবাস করে।
এজন্য বিষয়টি জিকা ভাইরাসের গুচ্ছ সংক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জিকা একটি আরএনএ ধরনের ভাইরাস। উগান্ডার জিকা নামের গ্রামের একটা বানরের শরীরে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। জিকা গ্রামের নামানুসারে ভাইরাসটির নাম জিকা দেওয়া হয়।
ডেঙ্গুর মতোই জিকা ভাইরাসের বাহক হচ্ছে এডিস মশা। আবাসিক এবং বুনো উভয় ধরনের এডিস মশা দ্বারাই জিকার সংক্রমণ ছড়ায়। ভাইরাসবাহী নারী এডিসের কামড়ে জিকা ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশের ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
তবে প্রতি ১০০ জন আক্রান্তের মধ্যে ৮০ জনের শরীরে জিকার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বাকি ২০ জনের দেহে রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ দৃশ্যমান হয়। জিকার সাথে ডেঙ্গুর লক্ষণগত মিল রয়েছে। জিকার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, শরীরে লাল লাল ফুসকুড়ি বা র্যাশ ইত্যাদি।
এসব উপসর্গ মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে। রোগের লক্ষণ দেখা যাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে রোগী সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যায়। জিকা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর ঘটনা বিরল। জিকা আক্রান্ত রোগী মারা না গেলে এই ভাইরাস নিয়ে এত উদ্বেগ কেন?
গর্ভবতী নারীর দেহে জিকার সংক্রমণ হলে গর্ভস্থ শিশুর মাথার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে ক্ষুদ্র মাথার শিশুর জন্ম হয়। স্বাভাবিকের তুলনায় মাথা ছোট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের আকার ক্ষুদ্র হয়। ফলে এদের স্নায়ুতন্ত্রের ও বুদ্ধির বিকাশ কম হয়, খিঁচুনি দেখা দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোট মাথার শিশুর বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক হতে পারে।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জিকার আক্রমণের পরে গুলেন ব্যারি সিনড্রোম Guillain–Barré syndrome বা জিবিএস নামের স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। জিবিএস রোগীর স্নায়ু অকার্যকর হয়ে যাওয়ার দরুণ ধীরে ধীরে শরীরের মাংসপেশিগুলো অবশ হয়ে যায়।
একসময় রোগী শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। নিবিড় পরিচর্যা সেবা ব্যতীত জিবিএসের রোগীকে বাঁচানো কঠিন। জিকার চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক হয়ে থাকে। তবে রোগীর বিশ্রাম, সুষম খাবার ও পর্যাপ্ত পানীয় এবং তরল খাবার গুরুত্বপূর্ণ।
জিকার কোনো টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গবেষণা চলছে। মশা ছাড়াও যৌনমিলন, আক্রান্ত মা থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে জিকার সংক্রমণ ঘটতে পারে। জিকার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে এডিস মশা নির্মূল করতে হবে। শুধুমাত্র এডিস মশাকে নির্মূল করা হলে আমরা ডেঙ্গু, জিকা, পীতজ্বর ইত্যাদি কয়েক ধরনের সংক্রামক রোগের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এডিস মশা নির্মূল করা না গেলে যেকোনো সময়ে দেশে জিকার মহামারি দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জিকা ভাইরাস