
লম্বা বনাম খাটো বিতর্ক
এক
আমার প্রয়াত পিতা মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন একজন শিক্ষা অফিসার। প্রাথমিক স্কুল ও শিক্ষকদের দেখভাল করা ছিল তার প্রধান দায়িত্ব। আমি তখন খুব ছোট, প্রায়শই শিক্ষকদের সাথে বাবার বৈঠক চলাকালীন উঁকিঝুঁকি দিতাম; কখনো-সখনো সেই সভায় সশরীরে হাজির থাকতাম। শিশু বলে কথা। ছোটবেলায় দেখেছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বেশ লম্বা ও হাড্ডিসার চেহারা‒তার নাম ধরা যাক মিনার আলি। এমন লম্বা ও পাতলা ছিলেন যে, মনে হতো একটু জোরে বাতাস বইলে তিনি হয়তো পড়ে যাবেন। মানুষ হিসেবে সহজ প্রকৃতির আর তাই বোধহয় মাঝে মধ্যে অকপটে বেফাঁস কথা বলে বিপদেও পড়তেন। সেই শ্রদ্ধেয় স্যারকে কেউ ঠাহর করতেন বোকা বলে; আবার কেউ ঠাট্টা করে বলতেন, আল্লাহ তোমাকে দৈর্ঘ্য দিয়েছেন মিনার আলি, কিন্তু প্রস্থ দেননি তাই তোমার এই অবস্থা। সেই থেকে এবং তারপর নানাভাবে, আমার মনে একটা ধারণা জন্মাতে থাকে যে লম্বা লোক সাধারণত বোকা প্রকৃতির হয়। আর আমি অপেক্ষাকৃত কিছুটা খাটো ছিলাম বলে সেই ‘গবেষণার’ ফলাফলে মোটামুটি তুষ্ট ছিলাম।
দুই.
আপাতত সে প্রসঙ্গ না হয় থাক। eLife নামে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পত্রিকায় মানুষের উচ্চতা নিয়ে সুন্দর একটা পর্যালোচনা বেড়িয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। প্রায় এক শতাব্দী সময়কাল বা ১০০ বছর ধরে বিস্তৃত (১৮৯৬-১৯৯৬) মানুষের উচ্চতার প্রবণতা নিয়ে এই গবেষণার সূত্রপাত। দুটো কারণে পাঠকের কাছে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি। প্রথমত, দেখা গেছে যে, শিশুকালের অপুষ্টিজনিত অবস্থা পূর্ণবয়সে আয় সংঘটনে প্রভাব রাখে এবং দ্বিতীয়ত, একটা দেশের বা সমাজের মানুষের গড় উচ্চতা সময়ভেদে পরিবর্তনশীল হতে পারে। তবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলার আগে ওই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধে প্রকাশিত আমার আশৈশব ধারণার বিপরীতে স্থান পাওয়া দীর্ঘকায় মানুষের আপেক্ষিক সুবিধা তথা বেটে মানুষের অসুবিধা নিয়ে দু-একটা কথা না বলে পারছি না। প্রাপ্ত গবেষণা বলছে, লম্বা মানুষের জীবন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ, বিশেষত লম্বা নারীদের অন্তঃসত্ত্বায় ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম এবং লিঙ্গভেদে সব লম্বা মানুষের হৃদরোগ বা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যায় থাকার সম্ভাবনা কম থাকে। তাছাড়া এমন প্রমাণও আছে যে লম্বা মানুষের গড়পড়তা শিক্ষা, উপার্জন (প্রতি ইঞ্চিতে মজুরি ৩ শতাংশ বেশি) এবং সম্ভবত সামাজিক অবস্থান বেশি এবং ওপরে। আর আগেও যেমনটি বলেছি, পূর্ণবয়সের উচ্চতা অনেকটাই নির্ভরশীল শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় মুখোমুখি হওয়া পুষ্টি ও রোগবালাইজনিত অবস্থার ওপর।
সময়ের বিবর্তনে শৈশব থেকে পূর্ণ বয়সে পৌঁছা অবধি আমার ধারণা বদলাতে শুরু করে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যে, লম্বা মানুষ মানে যেমন বোকা মানুষ নয়, তেমন খাটো লোক মানে বড়লোক বা বুদ্ধিমান মানুষ নয়। তবে দীর্ঘকায়দের কিছু সুবিধা তো সুবিদিত যেমন: লম্বা মানুষের এক কদম মানে খাটো মানুষের দুই কদম। তাই বোধ করি অলিম্পিকের ১০০ কিংবা ২০০ মিটার দৌড়ে‒ উইসান বোল্টের কথা বাদ দিলেও- লম্বা মানুষের দৌরাত্ম্য বেশি। বাস্কেটে বল ঝুড়িতে ফেলতে লম্বা মানুষের খুব একটা কসরত করতে হয় না; খাটো মানুষের বেলায় একই কাজ করতে অনেক লম্ফঝম্প করতে হয়। ক্রিকেটের জগতে ভিভ রিচার্ডস, সুনিল গাভাস্কার ও শচিন টেন্ডুলকার ছাড়া বিখ্যাত সবাই মোটামুটি লম্বা। সবশেষে, প্রত্যেক দেশের বিভিন্ন বাহিনীতে ন্যূনতম উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে মূলত খাটো মানুষকে নিবৃত রাখার জন্য। অর্থাৎ কিছু কিছু কাজ আছে, যা খাটোর সাথে খাপ খায় না।
তিন.
গবেষণার কথায় ফিরে আসা যাক। উক্ত গবেষণায় দেখা যায়, ১৮৯৬ সালে জন্ম নেওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে খাটো মানুষ দেখা যেত এশিয়া ও সেন্ট্রাল ও আনদিন লাতিন আমেরিকায়। যেমন, ১৮৯৬ সালের পুরুষ-কোহর্টের মধ্যে লাওসে গড়পড়তা উচ্চতা ছিল ১৫২.৯ সে.মি. (৩০ সে.মি = ১ফুট) যা আন্তর্জাতিক মানে নির্ধারিত নাদুস-নুদুস সাড়ে বার বছরের বালকের সমান। এর পর খাটোদের প্রাবল্য ছিল তিমুর ও গুয়েতেমালায়। একই সময়ে তিমুরে জন্ম নেওয়া নারীর উচ্চতা ছিল ১৪০.৩ সেন্টিমিটার, যা নাদুস-নুদুস ১০ বছর বয়সী মেয়ের সমান। এরপর যেসব নারী খাটো ছিলেন তারা এল সালভাদর, পেরু, বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে জন্ম নেওয়া। এক শতাব্দী আগে সবচেয়ে লম্বা মানুষ বাস করত সেন্ট্রাল ও নর্দান ইউরোপে, নর্থ আমেরিকায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপে। সুইডেন, নরওয়ে ও আমেরিকায় জন্মানো পুরুষ মানুষের গড়পড়তা উচ্চতা ছিল ১৭১ সেন্টিমিটার, যা লাওসের মানুষের চেয়ে ১৮-১৯ সে.মি. বেশি। এক শতাব্দী আগে সুইডিশ নারীরা ছিল সবচেয়ে লম্বা (১৬০.৩ সে.মি.)‒ যারা গুয়েতেমালার নারীদের চেয়ে ২০ সে.মি. বেশি লম্বা। নরওয়ে, আইসল্যান্ড, আমেরিকা ও আমেরিকান সামওয়াদের উচ্চতা ছিল ১৫৮ সে.মি. এর চেয়ে বেশি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অপুষ্টিজনিত রোগ
- শারীরিক উচ্চতা