ঘাড় থেকে আমলাতান্ত্রিক ফরমালিটিজের ভূত নামবে কবে
পৃথিবীর ইতিহাসে যারাই ঔপনিবেশিক শাসন করেছে, তাঁরা সবাই কলোনিগুলোতে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছে। আপনি ব্রিটিশ, ফ্রান্স, ডাচ, পর্তুগিজ—যাদের শাসনই দেখেন না কেন, দেখবেন—তাদের কলোনিগুলোতে কৌশল কিংবা শক্তি প্রয়োগ, যেভাবেই হোক না কেন, শাসকদের ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আচার-আচরণকে বদলে দিয়েছে। এমন স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে তারা দীর্ঘকাল তাদের শাসনকে টিকিয়ে রেখেছে। একই সঙ্গে তারা কলোনিগুলোতে এমন একটি ভাবাধারা ও চিন্তক প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পেরেছে, যাদের ভাবনায় ঔপনিবেশিক শাসক যা শিখিয়েছেন, সেটিকেই তারা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে ভালোবাসে।
গত শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে শেষের দিকে, ঔপনিবেশিকতার শিকল ভেঙে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই সব দেশের বেশির ভাগই ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা ও সংস্কৃতি থেকে আজও বের হতে পারেনি।
অনেক দেশের শাসক তো ক্ষমতা পেয়ে আরও বেশি ঔপনিবেশিক শাসক হয়ে ওঠে। আবার এমনও দেশ আছে, যারা ঔপনিবেশিকতাকে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ মনে করে, সেটিকে পুষে রাখাকে আবশ্যিক কর্তব্য মনে করে। কারণ, ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আচার-আচরণ বদলে দিয়ে এমন এক জাতিকে তারা বিনির্মাণ করেছে, তারা এর ব্যতিক্রম যে কিছু হতে পারে, সেটি ভাবতেই ভয় করে। এটা থেকে সামান্য বিচ্যুতিকে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রকাঠামোর অবক্ষয় হিসেবে দেখে এবং যেকোনো মূল্যে সেটিকে প্রতিহত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
অথচ সেই ঔপনিবেশিক শাসকেরা সময়ের সঙ্গে সব প্রথাগত ধ্যান-ধারণাকে বদলে দিয়ে নতুনের আবাহনে এগিয়ে নিয়ে দেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলছেন।
এবার পিএইচডি গবেষণা করতে যুক্তরাজ্যে (ব্রিটিশদের দেশে) আসার পর ইউনিভার্সিটি থেকে একটি আমন্ত্রণ পেলাম।
ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) নতুন এই গবেষকদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চান, পরিচিত হতে চান। একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চান। আমাদের ই–মেইল করল এবং সঙ্গে একটি ফরম পূরণের জন্য লিংক দিয়ে দিল। ওই ফরম ব্যবহার করে তারা আমাদের থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়ে নিল। ফরমটি সাবমিট করার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটি ই–মেইলের মাধ্যমে তারা অনুষ্ঠানস্থলের একটি ম্যাপের লিংকও পাঠিয়ে দিল, যাতে সহজে যেন অনুষ্ঠানের ভেন্যু খুঁজে পাওয়া যায়।
নির্ধারিত দিনের নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলাম। ভেন্যুর গেটে একজন একটি কিউআর কোড দেখিয়ে স্ক্যান করতে বললেন। অর্থাৎ স্ক্যানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছেন, সঠিক মানুষটি অনুষ্ঠানে এসেছেন কি আসেননি।
এসব পর্ব পেরিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে আমি ‘পুরোই হতাশ’। না আছে কোনো ব্যানার, না আছে কোনো চেয়ার। এ দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। নির্ধারিত সময়ে ভিসিও চলে এসেছেন। তিনিও এসে আমাদের সঙ্গে দাঁড়ালেন। তিনি একাই। সঙ্গে আর কেউ নেই!
এত বড় ইউনিভার্সিটির ভিসি, অথচ তিনি একা। আমার তো বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হলো। শুরুতেই ভিসি নিজেই মাইক নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর কথার মধ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজন তাঁকে দুই-তিনবার থামালেন; কিন্তু ভিসি কিছুই মনে করলেন না। এরপর তিনি কথা শেষ করে দুজন শিক্ষার্থীকে কথা বলার জন্য ডেকে নিলেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আমলাতান্ত্রিক
- প্রশাসন ব্যবস্থা