এক খ্যাপাটে সম্পাদকের আত্মঘাতী যুদ্ধের আখ্যান
জেমস অগাস্টাস হিকির জন্ম আয়ারল্যান্ডে। সুদূর ইউরোপের এক খেয়ালী ও খানিকটা খ্যাপাটে যুবক কীভাবে ভারতবর্ষের সাংবাদিকতার ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন ওই গল্প বেশ রোমাঞ্চকর। হিকি ওই অর্থে কোনো বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন না, ছিল না সাংবাদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা। তারপরও তার হাত ধরেই ভারতবর্ষে সাংবাদিকতার পথ চলা শুরু। তিনিই ভারতর্ষের সাংবাদিকতার জনক। তার হাত ধরেই প্রকাশিত হয়েছে শুধু ভারতবর্ষ নয় পুরো এশিয়ার প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র।
জেমস অগাস্টাস হিকি অভিজাত কেউ নন। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় কোনো কর্তাও ছিলেন না। তাই সঙ্গত কারণে হিকির জীবন ও সংবাদপত্র নিয়ে খুব বেশি তথ্য সংরক্ষিত হয়নি। যতদূর জানা যায়, তার জন্ম ১৭৩০-এর দশকে। তার বাবা পেশায় তাতী ছিলেন। হিকি বাল্যকালেই বাবাকে হারান। তরুণ বয়সে সংসার চালাতে ডাবলিনে একজন আইনজীবীর অফিসে কেরানির চাকরি নিয়েছিলেন। ওই কাজে সুবিধা করতে না পেরে চলে যান লন্ডনে। সেখানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ জোটে একটি ছাপাখানায়। কিছুদিন পর ওই কাজও ছেড়ে দেন।
নতুন কাজ নেন ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীতে। এ সময় তিনি দু-একটা যুদ্ধেও অংশ নেন। এরপর লন্ডনে ফিরে যোগ দেন এক বিখ্যাত উকিলের অফিসে। ওই আইনজীবী ইংল্যান্ডের দাস প্রথা নিষিদ্ধে কাজ করেছিলেন। ওই মামলায় অফিস সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন হিকি। তবে বেশিদিন এ কাজও তার ভালো লাগেনি। এরপর শল্য চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করেন। লক্ষ্য ছিল সার্জন হওয়া। কিন্তু ওই সময়ে লন্ডনে সার্জন হওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। তাই তিনি আবার সাগরে ফিরে যান একজন সার্জনের সাহায্যকারী হিসেবে। সেটি ছিল দাস ব্যবসায়ীদের একটি জাহাজ। এই জাহাজে কয়েকবার সমুদ্রযাত্রা করলেও মালিক তাকে কোনো পারিশ্রমিক দেননি। ফলে রাগ করে এই কাজও ছেড়ে দেন।
এরপর নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করেন— ভারতবর্ষ। অসমর্থিত তথ্যে জানা যায়, খুব সম্ভবত ১৭৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রকিংহাম নামের একটি জাহাজে চড়ে হুগলি নদীর মোহনায় পৌঁছান হিকি। দুই সপ্তাহ পর পৌঁছান কলকাতায়। এ সময় কলকাতার পরিবেশ খুব একটা সুবিধার ছিল না। রাজাদের শাসন ছিল শিথিল। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান বসতি স্থাপনকারীরা রাতারাতি প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছিলেন। যাদের শীর্ষে ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা। এ সময় কলকাতায় বিলাসী প্রাসাদ গড়ে উঠছিল। অন্যদিকে রাস্তঘাটে অপরাধীদের আড্ডাখানা। প্রশাসনিক, নগর শৃঙ্খলার কোনো বালাই ছিল না কলকাতার পথে-ঘাটে।
আগেই উল্লেখ করেছি ভারতবর্ষে সাংবাদিকতার সূত্রপাত করা বা সংবাদপত্র প্রকাশ করা হিকির লক্ষ্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভাগ্য পরিবর্তন করা। ওই সময় ভারতবর্ষ ছিল সম্পদে পরিপূর্ণ একটি মহাদেশ। যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরেদের ভাগ্য ফিরছিল রাতারাতি। হিকিও ওই লক্ষ্যেই কলকাতা এসেছিলেন। সংবাদপত্র প্রকাশ বা সাংবাদিকতার জনক হিসেবে ইতিহাসে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন কোনো অবস্থাতেই তার লক্ষ্য ছিল না।
কলকাতায় হিকি পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন শল্য চিকিৎসক হিসেবে। ছোট-খাটো রোগের নানা ধরনের ওষুধ দিতেন। রক্তপাত বন্ধ করতেন। তবে কিছুদিন পর ধারদেনা করে ছোট একটা জাহাজ কিনে কলকাতা-মাদ্রাজ মালপত্র পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। যদিও সমুদ্র ঝড়ে তার আমদানি করা মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন জেমস অগাস্টাস হিকি। পাওনাদারদের মামলায় তাকে জেলে যেতে হয়। আদালত তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। তবে হিকি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। জেল থেকেই নতুন করে শুরু করেন। কিছু টাকা জমিয়ে একটি ছাপাখানা খুলে বসেন। যাতে ছাপা হতো হ্যান্ডবিল, বিজ্ঞাপন, পঞ্জিকা, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দলিল ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ফর্ম। এই ব্যবসাটি প্রথম দিকে বেশ জমজমাট ছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাংবাদিক
- সাংবাদিকতা
- অভিজ্ঞতা