‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে কী হচ্ছে
জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে যেদিন 'সর্বদলীয়' বৈঠক হলো, সেদিন দুপুরের দিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের একটি খুদেবার্তা গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। সেটি এরকম: 'আজ ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, দুপুর ১টা ২৯ মিনিট বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদকের ফোনে নামবিহীন খুদেবার্তা পাঠিয়ে আগামীকাল বিকাল চার ঘটিকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে খসড়া ঘোষণাপত্র বিষয়ে আমাদের পর্যালোচনা উপস্থিত করতে বলা হয়। সঙ্গে ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়। আমরা জানতে পারি বৈঠকটি আগামীকালের নয়, আজ ১৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে। সার্বিক বিবেচনায়, খুদেবার্তায় আমরা আমন্ত্রণকারীকে জানিয়েছি, উল্লিখিত বিষয়ে পার্টিতে, আমাদের বাম জোটে, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করে এত অল্প সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ সম্পন্ন করা বাস্তবসম্মত নয়। সার্বিক বিবেচনায় সিপিবির পক্ষে আজ ১৬ জানুয়ারির বৈঠকে উপস্থিত থাকা সম্ভব হচ্ছে না।'
এদিন সকালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টিও বৈঠকে যোগ না দেওয়ার কথা জানায়। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সাংবাদিকদের বলেন, 'দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথের রাজনৈতিক দল। বুধবার রাত ৯টা ৫১ মিনিটের সময় একটি এসএমএস পাঠিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে দাওয়াত দেওয়াকে আমরা অসম্মানজনক ও অসৌজন্যমূলক আচরণ মনে করি। তাই আজকের সভা বর্জন করার জন্য লেবার পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।' এলডিপিও সম্ভবত এ কারণেই বৈঠকে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এই বৈঠকের সময় ছিল বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা। কিন্তু এতে বিএনপি অংশ নেবে কি না, সে বিষয়ে প্রায় ৩টা পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল। বিএনপির প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে বিএনপি যোগ দেবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। সম্ভবত বিএনপিও বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রক্রিয়া, ভাষা এবং সময় স্বল্পতার কারণে প্রস্তুতির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে দোটানায় ছিল যে, তারা আদৌ এই বৈঠকে অংশ নেবে কি না। উল্লেখ্য, এদিন দলের মহাসচিবও ঢাকায় ছিলেন না। শেষ মুহূর্তে জানা যায়, দলের স্থায়ী স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বৈঠকে যাচ্ছেন।
শেষ পর্যন্ত বৈঠকে বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণতন্ত্র মঞ্চ, খেলাফত মজলিস ও গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ), রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জেএসডি, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও জাতীয় গণফ্রন্টের প্রতিধিনিরা অংশ নেন। এর বাইরে জুলাই ঘোষণাপত্র জারির 'প্রধান স্টেকহোল্ডার' জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে দেখলে তিনি সাহস পান। তবে জুলাই ঘোষণার বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেন তিনি নিজেই। বলেন, 'কিছুদিন আগে ছাত্ররা এলো আমার কাছে। বলল, তারা একটি ঘোষণাপত্র দিতে চায়। আমাকেও থাকতে হবে সেখানে। আমি বললাম কী ঘোষণা? তারা বলল…। আমি বললাম এটা হবে না। কারণ ৫ আগস্টের ঘটনা ঘটেছিল ঐক্যের মাধ্যমে। সুতরাং এটা সবাইকে নিয়েই করতে হবে। তোমরা যেভাবে বলছ এভাবে হবে না। আমার এই কথায় তারা খুশি হয়নি। তবে পরে মনে হলো যে তারাও বুঝতে পেরেছে।'
বস্তুত ড. ইউনূস দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি উপলব্ধি করেছেন যে, যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের মতো করে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করে সেটি ঘোষণা করে দিত, তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য হত না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এটি নিয়ে অনৈক্য তৈরি হত— যা দেশের এই ক্রান্তিকালে একটি নতুন সংকটের জন্ম দিত।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই বছরের ১০ এপ্রিল জারিকৃত ঘোষণাপত্রের আলোকে 'প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলিউশন' বা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির কর্মসূচি দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে।
সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, এই 'জুলাই প্রোক্লেমেশন' হবে 'আগামীর বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র'। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে এর মাধ্যমে 'নাৎসি বাহিনীর' মতো 'অপ্রাসঙ্গিক' ঘোষণা করা হবে। একইসঙ্গে ১৯৭২ সালের 'মুজিববাদী' সংবিধানের 'কবর' রচনা করা হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণঅভ্যুত্থান
- ঘোষণাপত্র