আলোর পথিক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
বাংলা এবং বাঙালির জাগরণ ধারাকে বেগবান করার ভাবনায় উজ্জীবিত ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী পুরো দশকটি। তখন মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার আয়োজন চলছে। বাংলাভাষায় স্বাস্থ্যবিজ্ঞান পড়া বা ব্যাখ্যা করার উপায় ছিল না। কারণ সে সময় যথাযথ পরিভাষার তীব্র অভাব ছিল। তখন বাংলা একাডেমি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পরিভাষা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এই স্বপ্নকে সফল করার জন্য কয়েকজন অগ্রজ চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডা. আহমদ রফিক, ডা. সাঈদ হায়দার প্রমুখগণ। তাদের সাথে অপেক্ষাকৃত তরুণ আরও কয়েকজন যুক্ত ছিলেন। তাদের একজন হলেন ডা. শুভাগত চৌধুরী। ডা. আহমদ রফিক এবং ডা. শুভাগত চৌধুরী যৌথভাবে রচনা করেন ‘চিকিৎসাবিজ্ঞান পরিভাষা (২য় খণ্ড)’ নামের সমৃদ্ধ পুস্তকটি। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে যারা লেখেন বা লিখতে আগ্রহী তাদের জন্য বইটি এখনো গুরুত্ববহ। অনেকের মতো আমিও ডা. শুভাগতের নাম শোনার আগে তার মাকে জেনেছি। তার মা ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী খ্যাতিমান লেখক এবং শিক্ষাবিদ।
মানিকগঞ্জের এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের বৃহত্তর পরিবারে মহিলাদের পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক বেগম’ নিয়মিত আসতো। আমরা যারা বইপোকা ধরনের পড়ুয়া ছিলাম তারা মা, ফুফু, চাচি, আপাদের পড়া শেষ হয়ে গেলে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পড়ার সুযোগ পেতাম।
বিশেষ করে ঈদ ও নানা উৎসব বা বিশেষ সংখ্যায় অনেকগুলো গল্প উপন্যাস থাকতো। ‘সাপ্তাহিক বেগম’-এ তখন কেবল নারী লেখকদের লেখা থাকতো। সেখানেই প্রথম ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরীর নাম জানি এবং তার লেখা পড়ি। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর লেখালেখির সূত্রে ডা. শুভাগত চৌধুরীর নাম জানতে পারি। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের মঙ্গলবারের খেলাঘরের পাতায় শিশুকিশোরদের উপযোগী ভাষায় স্বাস্থ্য বিষয়ে লিখতেন।
স্বাধীনতার প্রথম দশকের শেষ অংশে আমি খেলাঘরের পাতায় কাজ করেছি। ১৯৪৫ সালে সিলেটের বিশ্বনাথ পরগণার জমিদার দেওয়ান শরৎচন্দ্র চৌধুরীর পৌত্র সিলেটের ‘ডিস্ট্রিক্ট অর্গানাইজার অব ওয়ার ফ্রন্ট’ শৈলেন্দ্র কুমার চৌধুরীর সাথে মঞ্জুশ্রীর বিয়ে হয়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। শৈলেন্দ্র-মঞ্জুশ্রী দম্পতির তিন সন্তান শুভাগত চৌধুরী, অরূপরতন চৌধুরী এবং মধুশ্রী চৌধুরী (বিয়ের পর মধুশ্রী ভদ্র)। ছোটভাই অধ্যাপক অরূপরতন চৌধুরী দন্তবিশেষজ্ঞ এবং স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ছোটবোন অধ্যাপনা করেন।
১৯৪৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শুভাগতের জন্ম হয়। শৈশবের পড়াশোনা শুরু হয় সিলেটে। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে তার ঠাঁই হয়। কিছুকাল সেখানে কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন সিলেটে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সিলেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন।
১৯৬৯ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর থেকে শুভাগত, ডা. শুভাগত চৌধুরী নামে পরিচিতি লাভ করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি এমফিল, এফসিপিএস পাস করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান। ইংল্যান্ডকে তখন বিলাত বা বিলেত বলা হতো। এছাড়া পৃথিবীর বেশকিছু উন্নত দেশে প্রবন্ধ পাঠ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি যান।
ছোটবেলা থেকেই গান, কবিতা ও নাটকের প্রতি তার সীমাহীন আগ্রহ। পড়াশোনার পাশাপাশি গান শিখেছেন, অবশ্য পরে গান ধরে রাখেননি। ছাত্রজীবন থেকেই অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন। কবিতা আবৃত্তিতে মগ্ন হতেন। ডা. শুভাগতের মায়ের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল ‘শিক্ষাই জীবন, জীবনই শিক্ষা’।
মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শুভাগতরা তিন ভাইবোন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেন। মেডিক্যাল বায়োকেমিস্ট্রির শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন।