প্রাণীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রোগ ও প্রতিকার
সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়। অনেক মানুষেরই বন্যপ্রাণী, পোষা প্রাণী ও সব ধরনের প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা অপরিসীম। তারা পৃথিবীর অংশ এবং তাদেরও অনুভূতির প্রয়োজন রয়েছে। বন্যপ্রাণী তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, আর পোষা প্রাণী আমাদের সঙ্গী হয়ে ভালোবাসা ও যত্নের দাবি করে।
আমাদের দায়িত্ব, তাদের প্রতি সদয় হওয়া এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মানবজীবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে, প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা দেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তবে যুগে যুগে প্রাণীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পৃথিবীতে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে এমন রোগের সংখ্যাও কম নয়।
প্রাণীবাহিত রোগ বা জুনোটিক ডিজিজ (Zoonotic Disease) হলো, যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় এবং এই রোগগুলো সাধারণত বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এসব রোগের কারণ হতে পারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী বা ফাঙ্গাস।
প্রাণীবাহিত রোগ শুধু মানুষের জন্য নয়, বরং এসব রোগ জীববৈচিত্র্য ও কৃষিক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। মানুষের মধ্যে এমন কিছু রোগের সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করেছিল। প্রাণীবাহিত রোগ দুই ধরনের হতে পারে, একটি হচ্ছে প্রাণীর মাধ্যমে নিয়মিত সংক্রমণ, আরেকটি হচ্ছে রোগটি প্রথমে কোনো একটি প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ তারপর মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ। এই রোগগুলো এমন রোগ, যা প্রথমে প্রাণী দেহে থাকে এবং পরে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
পৃথিবীতে প্রায় ২০০০-এরও বেশি জুনোটিক রোগের তালিকা রয়েছে। এই রোগগুলো নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, এবং পরজীবী দ্বারা সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন প্রাণী, যেমন মশা, কুকুর, বাদুড়, ইঁদুর, পাখি, বানর, শিম্পাঞ্জি, গরু, ভেড়া, উট, ছাগল, মেষ, ঘোড়া, মুরগি, শূকর ইত্যাদি মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়।
পৃথিবীতে কিছু পরিচিত প্রাণীবাহিত রোগের উদাহরণ—ম্যালেরিয়া (Malaria), ডেঙ্গু (Dengue), রাবিস (Rabies), ইবোলা (Ebola), হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস (HIV)/এইডস (AIDS), টিউবারকুলোসিস (Tuberculosis), প্লেগ (Plague), ওয়েস্টনাইল ভাইরাস জ্বর (West Nile Virus), সার্স (SARS), মার্স (MERS), লিসটারিওসিস (Listeriosis), হিস্টোপ্লাসমোসিস (Histoplasmosis), ক্যাম্পিলোব্যাকটারিওসিস (Campylobacteriosis)।
তবে, পৃথিবীতে আরও বহু জুনোটিক রোগ রয়েছে, যা বিভিন্ন প্রকারের প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জুনোটিক রোগগুলো মানুষের স্বাস্থ্য এবং প্রাণীর স্বাস্থ্যকে একই সাথে প্রভাবিত করে, তাই এগুলোর প্রতিরোধে সচেতনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে প্রাণীবাহিত রোগগুলোর মধ্যে কিছু রোগ রয়েছে, যেগুলো ব্যাপক আকারে মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং ইতিহাসে এই রোগগুলো মানবজাতির জন্য অনেক বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো—
ব্ল্যাক ডেথ (Black Death) বা প্লেগ: প্লেগ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণীবাহিত রোগ, যা ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় ব্যাপক আকারে ছড়ায়। এটি মূলত ইঁদুরের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল। ইঁদুরের শরীরে থাকা এক ধরনের পতঙ্গ ফ্লিয়া (Flea) প্লেগ রোগের ব্যাকটেরিয়া বহন করে এবং তাদের কামড়ে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগটি সংক্রামিত ব্যক্তির রক্ত এবং লালা মাধ্যমে মানবদেহে প্রবাহিত হতে পারে। এই মহামারি পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৭০ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ম্যালেরিয়া (Malaria): ম্যালেরিয়া একটি গুরুতর মশাবাহিত রোগ, যা মশার কামড়ে প্লাজমোডিয়াম পরজীবী মানবদেহে প্রবাহিত হয়। এটি রক্তের মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়ে লিভার এবং রক্তকণিকার ক্ষতি করে। ম্যালেরিয়া মূলত তীব্র জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, শরীরে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে। রোগটি যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয় তবে এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ম্যালেরিয়া বিশ্বের ৮৫টি দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তবে এটি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় বেশি বিস্তৃত। বাংলাদেশেও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই রোগটির প্রাদুর্ভাব রয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রতিকার
- ছড়িয়ে পড়া
- প্রাণীবাহিত রোগ