দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ
বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি এই বছর ছয় দশমিক চার শতাংশ বাড়তে পারে, যা তাদের আগের পূর্বাভাস থেকে বেশি। অঞ্চলভিত্তিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই হারে বিগত বছরের মতো এবারও শীর্ষে রাখবে এই অঞ্চলকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য আরও উন্মুক্ত হলে এই অঞ্চলের সম্ভাবনা আরও বাড়বে, যা দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে।
ভারতের শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি অন্যান্য দেশগুলোর দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে আগামী দুই বছরে প্রতি বছর অন্তত ছয় দশমিক দুই শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হয়েছে।
এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তব হলে তা অবশ্যই খুশির খবর। তবে এর অপর পিঠে এই পূর্বাভাসও কিছুটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চরম আবহাওয়া, ঋণের চাপ, সামাজিক অশান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা। আবার পরিকল্পিত সংস্কারগুলোতে দেরি করার মতো নীতিগত ভুলও প্রত্যাশিত বৃদ্ধিতে ধীরগতি সৃষ্টি করতে পারে। অস্থির আর্থিক পরিস্থিতি, বহিঃবিশ্বের বাহ্যিক চাপের বিপরীতে এই অঞ্চলে এসব ঝুঁকির বিরুদ্ধে খুব অল্পই সুরক্ষা নীতিমালা রয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রিয়েস বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ, কিন্তু পূর্ণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়নে দেশগুলো আরও অনেক কিছু করতে পারে।” তিনি মনে করেন, এ জন্য মূল নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন, যা আরও বেশি করে নারীদের জাতীয় শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা দূর করে তা বৃদ্ধিতে ত্বরান্বিত করতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে, এই অঞ্চলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ যদি পুরুষের সমান হয়, তবে আঞ্চলিক জিডিপি প্রায় ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২৩ সালে, শুধু ৩২ শতাংশ কর্মক্ষম নারী শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করেন, যেখানে পুরুষের হার ছিল ৭৭ শতাংশ। ভুটান বাদে অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার উন্নয়ন একই স্তরের দেশের তুলনায় ৫ থেকে ২৫ শতাংশ কম। এই হারটি বিবাহিত নারীদের মধ্যে সবচেয়ে কম। গড়ে দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার বিয়ের পরে ১২ শতাংশ হারে কমে, এমনকি তাদের যদি কোনো সন্তান না থাকে তবুও তারা আর্থিক কর্মকাণ্ডে খুব একটা যুক্ত হন না। যেহেতু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বেশি সেবাখাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে, সেহেতু নারীর শ্রমের জন্য চাহিদা বাড়ছেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রবণতা এখনও নারীর কর্মসংস্থানে বাড়তি অবদান রাখতে পারেনি, কারণ এই অঞ্চলের কোম্পানিগুলো প্রায়ই পুরুষদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়। অন্যদিকে, শিশু যত্ন সেবা, পরিবহন ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আইনগত সীমাবদ্ধতা এবং রক্ষণশীল লিঙ্গ নীতির মতো বিভিন্ন কারণ নারীর শ্রমের সরবরাহকে প্রতিনিয়ত কমিয়ে দিচ্ছে।
পাশাপাশি, একই কাজের জন্য নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্যও এই অঞ্চলে অনেক বেশি। যেমন বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ ৪৩ শতাংশে উন্নীত হলেও একই ধরনের কাজের জন্য পুরুষ সহকর্মীরা যা উপার্জন করেন, নারীরা তার মাত্র ৬০ শতাংশ উপার্জন করতে পারেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, পাকিস্তানের অবস্থা আরও শোচনীয়। সেখানে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাধার সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তার সংকটও। মজুরিও লক্ষ্যণীয়ভাবে বৈষম্যমূলক। ফলে নারীর অংশগ্রহণও সেখানে অনকে কম। তাছাড়া ভারতে গড়ে একজন পুরুষ যেখানে ৫১ মিনিট অবৈতনিক কাজকর্ম করে, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে সেটা ৩৫২ মিনিট। মেকেন্সি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় যদি নারী-পুরুষের এসব বৈষম্য কমানো যায়, আগামী অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপিতে অতিরিক্ত তিন দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলার যোগ হতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শ্রমশক্তি
- নারীর অংশগ্রহণ