রাজনৈতিক দলের সংস্কার করবে কে?
‘প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে আপনি বা আপনার কোনো সহকর্মী কখনো কি দলের সভাপতির কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন?’ বছর কয়েক আগে এক টিভি টকশোতে আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি প্রশ্নটির সরাসরি কোনো জবাব দেননি। তবে দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তথা দলীয় প্রধানের সঙ্গে দ্বিমত ও ভিন্নমত পোষণের জায়গায় এখনও যে একটি বিরাট জুজুর ভয় রয়ে গেছে, তার বক্তব্যে সেটি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি আমরা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যেমন সংসদ সদস্যদের নির্ভয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের কণ্ঠনালি চেপে ধরে বলে মনে করা হয়, তেমনি পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি এবং দলীয় প্রধানের একাধিপত্য আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
প্রসঙ্গত, এক-এগারোর সরকার নামে পরিচিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে মতবিনিময়ের ভিত্তিতে দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনসহ অনেকগুলো সংস্কার ধারণা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। ওই অধ্যাদেশে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর ছয় মাসের মধ্যে অনুমোদিত গঠনতন্ত্র কমিশনে জমা দেওয়ারবিধান করা হয়েছিল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত হওয়া, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটির শতকরা ৩৩ ভাগ সদস্যপদ নারীদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে আখেরে দলগুলোর ভেতরে কতটুকু গণতন্ত্রায়ন হয়েছে, তা নিয়ে সেই সব তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে যে শব্দগুলো, তার অন্যতম ‘সংস্কার’। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনি ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন ও গণমাধ্যমের মতো বিষয় থাকলেও রাজনৈতিক দল সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দলের সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রের কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। যে রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশ পরিবর্তন করতে চান, সত্যিই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে চান— তাদের দলের ভেতর সংস্কার হবে কিনা বা সেই তাগিদটা তারা অনুভব করেন কিনা, ওই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এই কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে সংবিধান, আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য। রাষ্ট্র যদি সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে তার প্রধান স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার হচ্ছে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল নিজেও একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানের নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সফলতা-ব্যর্থতার ওপর রাষ্ট্রের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে। রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না। দলের ভূমিকা খর্ব হলে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হলে ওই সুযোগে বিভিন্ন অরাজনৈতিক গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তারা তখন জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরায়।
কেন দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলের ভেতরে গণতন্ত্রের সংকট দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত একটি বিষয়। কেন দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না, তার পেছনে কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন:
১. কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একক নেতৃত্বের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। দলের সর্বোচ্চ নেতা প্রায় সব সিদ্ধান্ত নেন, যাতে নিচের স্তরের নেতা-কর্মীদের মতামত উপেক্ষিত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন এমন একজন জাতীয় নেতার মেয়ে আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, বছর কয়েক আগে তার বাবার আসন থেকে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখন তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়, নেতার প্রতি শত ভাগ অনুগত থাকতে হবে। এই কথা শোনার পরে তিনি বুঝতে পারেন যে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। কারণ ‘শত ভাগ আনুগত্য’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তিনি সেটি আগেও দেখাননি, পরেও দেখাতে পারবেন না। বস্তুত বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতার প্রতি শতভাগ তথা নিঃশর্ত আনুগত্যের এই চর্চা দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরকে একধরনের দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে রাখে। সংসদে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার মতো তারা এখানেও দলের নেতার সবকিছুতে ‘হ্যাঁ’ বলে সম্মতি জানান। বস্তুত এই ধরনের একক নেতৃত্ব-নির্ভর ব্যবস্থা দলে ভিন্নমত এবং বিকল্প চিন্তার চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে।
২. দলের ভেতরে নিয়মিত নির্বাচন না হওয়া। দলীয় পদ-পদবি বণ্টনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া না থাকা।
৩. কাউন্সিল হলেও দলীয় প্রধানের ওপর পুরো কমিটি গঠনের দায়িত্ব দিয়ে তার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও আনুগত্যের ঘোষণা প্রকাশ। অর্থাৎ কাউন্সিলে অনেক সময়ই দেখা যায় যে, দলীয় প্রধান নির্বাচিত (মনোনীত) হওয়ার পরে দলের অন্যান্য কমিটি গঠনের দায়িত্বও তার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এটি একটি সামন্তবাদী প্রথা এবং কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দলীয় প্রধান নিজেও এই ধরনের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখান না। কারণ তিনিও চান এই ক্ষমতাটি তার হাতেই থাকুক।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক দল
- সংস্কার