গণ-অভ্যুত্থানে প্রথম আলোর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দায়
কিছুদিন আগে অন্তর্বর্তী সরকার আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করেছে। এই দিবসগুলোর মধ্যে ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট আর ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবসকে রাখার পক্ষে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। সেই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুরুত্ব নিয়েও তিনি কথা বলেন। এই লেখা প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে-বাইরেও সমালোচনা লক্ষ করা গেছে। অনেকের কথায় মনে হতে পারে, এই পত্রিকা বুঝি পতিত শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষেই কথা বলছে!
কিন্তু আসলেই কি তা-ই? বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন আর যৌক্তিক সমালোচনা করলেই ক্ষমতাসীন সরকারের রোষানলে পড়ার নজির নতুন কিছু নয়। যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন, দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার। টক শোতে বলা একটি বক্তব্যকে কেন্দ্রে করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শ খানেক মামলা দেওয়া হয়েছিল।
শুধু তা–ই নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম জাতীয় সংসদের সমাপনী এক বক্তব্যে বলতে বলেছিলেন, ‘মিডিয়ার জন্য যত বেশি সুযোগ দিয়েছি, আমি তত বেশি ভিকটিম হয়েছি। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পর থেকে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার পড়ি না। আমার বিরুদ্ধে ২০ বছর ধরে লিখে আসছে।’
দেশের শীর্ষস্থানীয় এ দুই পত্রিকাকে নিয়ে বিষোদ্গার করার পর হাসিনা সরকারের অনেক নেতা-কর্মী এ দুই গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করতেন। পত্রিকা দুটি সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিল। প্রতিকূল পরিবেশেও যখন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে আসছিল, তখন শেখ হাসিনা সরকার নানাভাবে গণমাধ্যমকে দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে নানাভাবে প্রথম আলোর কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছিল।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে হয়রানির চেষ্টা করা হয়।
এ ছাড়া গত বছর ২৬ মার্চে সাভারের এক দিনমজুরের মন্তব্য ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ লেখাসংবলিত ফটোকার্ড নিয়ে আরেক দফা হয়রানি করা হয়। সেই প্রতিবেদনের প্রতিবেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্পাদকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই ছিল।
পক্ষান্তরে এই পত্রিকাগুলো কী করেছে, প্রতিশোধ নিয়েছে? না, এটা গণমাধ্যমের চরিত্র নয়। নিউটনের তৃতীয় সূত্র গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ, পত্রিকার কাজ ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর ধারণ করা। পত্রিকার কাজ কখনোই ক্ষমতাসীনদের ‘পিআর’ (পাবলিক রিলেশন বা জনসংযোগ) স্টেশন হওয়া নয়।
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গেলে আপনি কখনোই ক্ষমতাসীনদের প্রিয়ভাজন হতে পারবেন না। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা গণমাধ্যমগুলোর ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বর কখনোই পাঠকেরা গ্রহণ করতে পারে না; যার প্রমাণ এই চব্বিশের বিপ্লব।