কোন প্রক্রিয়ায় ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানো এবং পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলে সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই করবে বিএনপি। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন দলটির সিনিয়র নেতা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। এর আগের দিন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে ১০ দফায় যে ৮১টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেখানেও স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়টি রয়েছে।
একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই বিধানটি বাতিল করা হলে ২০১৪, ২০১৮ এবং সবশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে—যার প্রতিটি নির্বাচন নিয়েই দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
বলাই হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংকট এবং একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো, তার পেছনেও রয়েছে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়ার বিষয়টি। কেননা, বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতির যে অঙ্ক, তাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে একই দলের পক্ষে পরপর দুবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ কম। উপরন্তু ভোট অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে কোনো দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভও অসম্ভব ব্যাপার। যদিও ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে—যে ফলাফলকে বিএনপি বরাবরই 'অস্বাভাবিক' বলে দাবি করে আসছে।
তবে ত্রুটিবিচ্যুতি ও বিতর্কের পরেও বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেখানে নির্বাচনপূর্ববর্তী সরকারি দল কখনোই জয়লাভ করেনি। ফলে মাঠ ও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্যই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করেছে। যদিও তারা এটা করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে। উপরন্তু আওয়ামী লীগের তরফে বরাবরই বলা হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি গণতান্ত্রিক নয় এবং আধুনিক বিশ্বে এই সিস্টেম অচল। অতএব এই যুক্তিও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই বাস্তবতার কি অবসান হয়েছে? ত্রুটি ও বিতর্কমুক্ত নির্বাচনি ব্যবস্থার জন্য যেসব দেশকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া হয়, সেসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কি গণতান্ত্রিক, সহনশীল ও বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পেরেছে? এর সহজ উত্তর হলো 'না'। অতএব এই যুক্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিলকে দেশের সব রাজনৈতিক সংকটের উৎস বলে মনে করা হয়।
এরকম বাস্তবতায় বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিলো যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই সংশোধনী বাতিল অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় রিভিউয়ের (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করা হবে।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে নতুন করে আলোচনায় আসে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় রিভিউয়ের বিষয়টি। গত ২৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের চেম্বার আদালতের অনুমতি নিয়ে দেশের পাঁচজন নাগরিক রিভিউ আবেদন করেন। তারা হলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেট শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন রিভিউ আবেদন করেন।