ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে তৃষ্ণার্ত শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মিটবে না
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিবছর এই দিনটাকে পালন করা হয়।
বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশের ৩০ মিলিয়ন শিক্ষক ও ৫০০টি সংগঠন শিক্ষকদের সম্মানার্থে এই দিবসটি উদযাপন করছে। এইদিন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিবসে এই দিনটি উদযাপন করা হলেও ৫ অক্টোবর মূলত ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি উপলক্ষে Education International প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে-যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশায় অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৪ এর প্রতিপাদ্য হলো—“শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার।”
১৯৪৭ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে ‘শিক্ষা সনদ’ প্রণয়নের আলোচনার প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত করার জন্য ১৯৫২ সালে ‘বিশ্ব শিক্ষা সংঘ’ গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকারের বিশেষ সম্মিলনে শিক্ষকদের পেশাগত অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা বিষয়ক ঐতিহাসিক ইউনেস্কো আইএলও সুপারিশ প্রণীত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯০ সালে ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় বেলজিয়াম ভিত্তিক Education International বা আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংগঠন। বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের ১৭০টি রাষ্ট্রের শিক্ষক সম্প্রদায় ২৪ ঘণ্টার জন্য হলেও ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দাবি জানান ইউনেস্কোর কাছে।
বিশ্ব শিক্ষক সম্প্রদায়ের তীব্র দাবির মুখে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডরিক প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। পরের বছর (১৯৯৫ সালে) ৯ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং শিক্ষক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এই দিবসটি পালনে নীরব থাকলেও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সরব ছিল। ২০২৩ সালে ২য় বারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে আবারও বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়।
এবছর (২০২৪ সাল) রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাউশির মাধ্যমে একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছে। যে নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ের সাধারণ ও মাদরাসায় ১টি করে মোট ২টি, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ, কারিগরি ও মাদরাসা, ১টা করে মোট ৩টি এবং কলেজ পর্যায়ের সাধারণ, কারিগরি ও মাদরাসা, ১টি করে মোট ৩টি সম্মাননা পদক প্রদান করা হবে। এছাড়াও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ১টি, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় ১টি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১টি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ১টি। সর্বমোট ১২টি সম্মাননা পদক দেওয়া হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি চাইলে বিশেষ প্রয়োজনে সম্মাননার স্তর ও সংখ্যা বাড়াতে-কমাতে পারবেন। দেশের সব উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে এই নীতিমালার আলোকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হবে। প্রাথমিক (সমপর্যায়), মাধ্যমিক (সমপর্যায়), কলেজ (সমপর্যায়), মাদরাসা, কারিগরি, সব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে এ দিবসটি উদযাপন করা হবে। দিবসটি উদযাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে।
এ দিবসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রতি বছর ইউনেস্কো ঘোষিত প্রতিপাদ্য অনুযায়ী বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা। জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা ও অবদান সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও গুণী শিক্ষক সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে সকল শিক্ষককে সম্মানিত করা।
উল্লেখ্য, নানা ক্যাটাগরিতে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও, শিক্ষক-প্রশিক্ষণের মেইন স্টেকহোল্ডার বলে পরিচিত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজকে এই নীতিমালার আওতায় আনা হয়নি, যা দূর্ভাগ্যজনক এবং বৈষম্যমূলক। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের ঘোষণার সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হলেও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোর ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে করি। বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নিলেও ইউনেস্কো আইএলও সনদের ভিত্তিতে প্রণীত এই দিবসটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত এখনও গৃহীত হয়নি। ফলে স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও যেমন শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও ন্যায় সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি তেমনি শিক্ষার গুণগতমান এবং শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধাও নিশ্চিত করা যায়নি। সর্বোপরি, এই দীর্ঘ ৫ দশকের বেশি সময়েও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা যায়নি। অথচ এই শিক্ষানীতিতে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে, যার কিছু বাস্তবায়িত হলেও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চরম বৈষম্যে বিরাজমান থাকার কারণে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতি হয়নি। ফলে আজ বেসরকারি শিক্ষক, শিক্ষকদের শিক্ষকও (টিটিসি'র শিক্ষক) বঞ্চনার শিকার হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত। তাদের হতাশা থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ শিক্ষক সমাজকে এখনও অধিকার আদায়ের জন্যে শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়৷
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্ব শিক্ষক দিবস