যা ঘটেছে তা মোটেও কাম্য ছিল না!
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর দেশব্যাপী যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন দমনের নামে পুলিশ যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন জেলার থানাগুলো আক্রমণের শিকার হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশকে হত্যা করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। অগ্নিসংযোগ করে পুলিশের গাড়ি এবং থানা ভবন পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে, এর মধ্যে যে স্পর্শকাতর বিষয়টি ঘটেছে তা হলো, দেশের কোনো কোনো স্থানে হিন্দু জনগণ ও তাদের বাড়িঘর আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘর লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এই অনৈতিক আক্রমণের হাত থেকে মন্দিরও রেহাই পায়নি। এসব ছাড়াও আরও দুটো বিশেষ ঘটনা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত মনে হয়েছে। সংসদ ভবনে প্রবেশ করে পবিত্রতা নষ্ট করা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে মুক্তিসংগ্রামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ কাজটি সম্পূর্ণ অন্যায্য মনে হয়েছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অর্জিত বিজয়কে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, সিরামিক অথবা টেরাকোটা দিয়ে দেয়ালে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও উপড়ে ফেলা হয়েছে। এসব ভাস্কর্য ও ম্যুরাল বেশির ভাগই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ভাস্কর্যও ছিল। রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মৃণাল হকের ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়াগাড়ি ও রিকশার ভাস্কর্যও রেহাই পায়নি। দুর্বৃত্তরা ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাসের মূর্তি, সুপ্রিম কোর্টের থেমিস ও শিশু একাডেমির দুরন্ত ভাস্কর্যটিও ধ্বংস করে দিয়েছে। ময়মনসিংহের জয়নুল সংগ্রহশালার সামনে থাকা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ মূর্তিটিও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
খারাপ লেগেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শামীম সিকদারের ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’ ভাস্কর্যটির ধ্বংসাবশেষ দেখে। সেখানে ছোট-বড় শতাধিক পৃথক ভাস্কর্য ছিল। এর মধ্যে অক্ষত ছিল পাঁচটি। বাকিগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছে। দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানীদের আবক্ষ ভাস্কর্য কিছুই রক্ষা পায়নি। দুর্বৃত্তদের হাতে লালন শাহ, ইয়াসির আরাফাত, জগদীশচন্দ্র বসু ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্যও ধ্বংস হয়েছে। শেখ হাসিনার অপরিণামদর্শিতা এবং অন্য অনেক কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়েছে বুঝলাম; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ধ্বংস করা হলো কেন? শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপর চারদিকে যখন বিজয় উৎসবে দেশ ব্যস্ত, ঠিক তখনই একদল মানুষ এত দিনের পুঞ্জীভূত দুঃখ-কষ্ট ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে দেশব্যাপী ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ধ্বংস শুরু করে। এই সুযোগে ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুণ্ঠনকারী ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ওপর গড়ে ওঠা ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ধ্বংস করেছে। এসব লক্ষণ ভালো নয়। শত শত মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, ধর্মের মুখোশধারী এসব সুযোগসন্ধানীর অপকর্মে যেন সে বিজয় হাতছাড়া না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
দেশজুড়ে এই নৈরাজ্যে আরও একটি বিশেষ ঘটনা মন খারাপ করে দিয়েছে। দুর্বৃত্তরা বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়িটিও সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ঋত্বিক ঘটক হিন্দু বলে তাঁর পৈতৃক বাড়ি ধ্বংস করতে হবে—এ কেমন কথা! ঋত্বিক ঘটক ছিলেন অবিভাজ্য বাঙালি। তাঁর শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে রাজশাহীর এই পৈতৃক বাড়িতেই। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা নাটোরের মহারানির বংশধর। বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বদলির চাকরির কারণে সুরেশ চন্দ্র ঘটক পরিবার নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে বসবাস করেছেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি রাজশাহীর ঘোড়ামারা মহল্লার মিয়াপাড়ায় গিয়ে বাড়ি করেন। ঋত্বিক ঘটক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁর পরিবার কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হওয়ার মর্মবেদনা তিনি কোনো দিনও ভুলতে পারেননি। দেশভাগ ঋত্বিক ঘটকের বুকে একটি স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। কলকাতার উদ্বাস্তু জীবন তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাঁর জীবন-দর্শন নির্মাণে এ ঘটনা ছিল সবচেয়ে বড় প্রভাবক, যা পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বারবার ফুটে উঠেছে। এর প্রতিফলন দেখি তাঁর নির্মিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রে। তৎকালীন কলকাতার অবস্থা ও উদ্বাস্তু জীবনের রূঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে এসব চলচ্চিত্রে। কলকাতায় চলে গেলেও ১৯৪৮ সালের পর থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়েছেন নিয়মিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধও তাঁকে তাড়িত করেছে প্রবলভাবে। সেই তাড়নাতেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে কলকাতার জ্বলন্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে শরণার্থীদের জন্য হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করেছেন নির্দ্বিধায়। তিনি নিজের জীবনকালে যেহেতু কখনো দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি, এ জন্য গঙ্গা ও পদ্মা তাঁর কাছে একই স্রোতোধারার দুটো নাম ছিল মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই যুদ্ধের ওপর তিনি তৈরি করেছিলেন ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ নামের একটি বিশেষ তথ্যচিত্র, যা ১৯৭১ সালেই কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পটভূমিকায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। এরও আগে স্বাধীনতার পরপর তিনি এতটুকু সময় নষ্ট না করে পিতৃভূমি দেখার জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। সে সময়, দেশের সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল। ঋত্বিক ঘটক ১৯৭২ সালে ঢাকার নিউ ইস্কাটন এলাকায় স্থাপিত একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে এক মাস কাটিয়ে সড়কপথে রাজশাহীর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক বাড়ি হয়ে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
অসম্ভব সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক ধ্রুবতারা। তাঁর নির্মাণ করা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে কিংবদন্তি। বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে তিনি তুলনীয়। প্রখ্যাত এই তিন চলচ্চিত্র পরিচালকের আদিবাস এই বাংলাদেশেই। ঋত্বিক ঘটক জীবদ্দশায় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন মাত্র ৮টি। স্বল্পদৈর্ঘ্য, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র সব মিলিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ১০টি। হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। ঋত্বিক ঘটকের সৃষ্টিশীল কাজের হাতেখড়ি রাজশাহীর মিয়াপাড়ার ওই বাড়িতেই। ‘অভিধারা’ নামে একটি সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করতেন ঋত্বিক ঘটক। ওই সময় রাজশাহীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের। প্রতিবছর শীতকালে রাজশাহীতে সাহিত্য-সংগীত সম্মেলন হতো। সেই সময়ের স্থানীয় রাজা ও জমিদারেরা এই সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ঋত্বিক ঘটকের বড় ভাই মনীশ ঘটক এ কাজের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। এসব কাজে তাঁর সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। এ উপলক্ষে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, হুমায়ুন কবীরের মতো বড় বড় মনীষীর পদার্পণ ঘটত ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িতে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও ভারতীয় কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের আগমনও ঘটেছে ওই বাড়িতে। এ বাড়িতেই থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইয়ের মেয়ে বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। বলা হয়ে থাকে, সে সময়ের রাজশাহীর সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সূতিকাগার ছিল ঋত্বিক ঘটকের এই পৈতৃক বাড়ি। বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের বহু গুণীজনের পদধূলি পড়েছে এই বাড়িতে। এই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিদের অনেক স্মৃতি ছিল ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িটিকে ঘিরে।