নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব, না পুরাতন শক্তির রূপান্তর?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু এভাবে যে ঘটবে, সেটা সম্ভবত তাঁর কঠিনতম শত্রুও ভাবতে পারেনি। যিনি প্রায়ই প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতেন, তাঁর হারানোর কিছু নেই; তিনি পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নন; সেই তিনিই সকলের অগোচরে, এমনকি নিজ দলের নেতাকর্মীকেও না জানিয়ে, গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন!
অবশ্য শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ যে হঠাৎ করেই ঘটে গেছে, এমনটি ভাবলে ভুল হবে। এক দশক ধরেই নানা কারণে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। কিন্তু জনমনের সেই ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করতে কার্যকর কোনো গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি কেউ। সেই কাজটিই করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কারের মতো আপাত সাধারণ দাবি যে রাজনৈতিক স্ফুলিঙ্গ হয়ে সরকারের সাজানো তাসের ঘর জ্বালিয়ে দেবে, সেটা ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব বা তাঁর গোয়েন্দা বাহিনীগুলো ভাবতেও পারেনি। নেপথ্যে আরও কারও ভূমিকা ছিল কিনা, আগামী দিনের গবেষকরা হয়তো খুঁজে বের করবেন। কিন্তু প্রকাশ্য সত্য এটাই, ছাত্রদের দাবির সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গড়ে উঠেছিল এক অবিস্মরণীয় আন্দোলন, যা এর আগে কেউ দেখেনি।
ছাত্র-জনতার এমন আন্দোলন বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশেরই শুধু নয়, বিশ্বের বহু সংগ্রামী আখ্যানকেও নানাভাবে অতিক্রম করে গেছে। বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীদের ঐক্য ও দৃঢ়তা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এ প্রজন্মের বুকের ভেতর যে এত বারুদ জমে ছিল, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। এটি দিয়েই এরা লড়েছে ফ্যাসিবাদী বাহাদুরির বিরুদ্ধে। দু’হাত প্রসারিত করে আবু সাঈদ যেভাবে বুক পেতে দিয়েছে ঘাতক বুলেটের সামনে; বুক ঝাঁজরা হয়ে গেছে, তবুও পিছু হটেনি; সেভাবেই শত শত ছাত্র-জনতা রুখে দিয়েছে দমন-পীড়নের সব শক্তি।
ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান যে শুধু হাসিনা সরকারের পতনই ঘটিয়েছে, এমন নয়। দেশের প্রথাগত রাজনীতিকেও প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। এই পরিবর্তনের প্রভাব অবশ্যম্ভাবীভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে নতুন রূপ নিতে বাধ্য করবে। ২০২৪ সালের এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা স্থায়ী মাইলফলক হয়ে থাকবে– যেমনটি হয়ে আছে ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১।
প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, ইতিহাস যখন বাঁক নেয়; পুরোনো চিন্তা, পুরোনো শক্তি সবকিছুই নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। অনেক সময় পুরোনো শক্তির বিলুপ্তিও ঘটে। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের পর যখন পাকিস্তানের জন্ম হলো, সে সময়ের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি ছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এই ঐতিহ্যবাহী দলটি তার আবেদন হারাতে শুরু করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম নেয় নতুন রাজনৈতিক শক্তি– আওয়ামী লীগ, ন্যাপ। কারণ একটাই। মুসলিম লীগ ঔপনিবেশিকতার নিগড় থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা এ অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারেনি। এক পর্যায়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রাম, যার অনিবার্য পরিণতি স্বাধীনতা আন্দোলন। এর মাঝে মুসলিম লীগ প্রায় বিলীন হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ দেশভাগ-পরবর্তী মুসলিম লীগের মতোই স্বাধীন দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হলো। উন্মেষ ঘটল নতুন শক্তির– জাসদ। দলে দলে মেধাবী তরুণ জাসদে এসে ভিড় করল। কিন্তু নানা কারণে জাসদও ব্যর্থ হলো। ক্রমে জন্ম নিল বিএনপি, জাতীয় পার্টি। একইভাবে ২০২৪ সালে আগস্ট অভ্যুত্থানও যদি নতুন শক্তির সমাবেশ ঘটায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
নতুন শক্তির আবির্ভাব কিংবা পুরাতন শক্তির রূপান্তর– যে শক্তিই এ দেশে রাজনীতি করবে, তাদের নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেই রাজনীতি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, আজকে যে প্রজন্ম আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তারা গত শতাব্দীর ষাট, সত্তর বা আশির দশকের প্রজন্ম নয়। এ প্রজন্মের ভাষা, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই আগের প্রজন্ম থেকে আলাদা। এদের কাছে রাজনীতির গূঢ় তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে জীবনের চাহিদাকেন্দ্রিক বিষয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। এদের ভালোবাসা, প্রেম, যাপিত জীবন সবকিছুই ভিন্নতর। এদের কাছে বৈবাহিক জীবনও এক ধরনের অংশীদারিত্ব। তরুণ সমাজের মনোজাগতিক এ পরিবর্তনকে ধারণ করেই আগামী দিনে রাজনীতিবিদদের এগিয়ে যেতে হবে।
আরও মনে রাখতে হবে, একুশ শতকে পৃথিবী রাজনীতি, অর্থনীতিসহ চিন্তা-চেতনার সব ক্ষেত্রেই এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। স্বভাবতই এতে যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে গড়ে উঠেছে বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনাতেও। রাজনীতিও হয়ে উঠছে জটিল থেকে জটিলতর। এখনকার তরুণরা রাজনীতির চিরায়ত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের চেয়ে জীবনের তাৎক্ষণিক এবং আশু সমস্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তারা বাঁচতে চায়, সেই সঙ্গে বেঁচে থাকাকে উপভোগ করতেও চায়। স্বাভাবিকভাবেই নতুন যুগের এই নতুন চ্যালেঞ্জকে পুরোনো ধ্যান-ধারণা দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
পরিবর্তিত এই দেশীয় ও বৈশ্বিক বাস্তবতা সামনে রেখেই সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতিকে বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বে তরুণ জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। আবার এই তরুণদের একটা বিশাল অংশ বেকার বা কর্মহীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যমতে, বাংলাদেশের স্নাতক ডিগ্রিধারীদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।