‘কেমন পুরুষ তুমি, ঘুষ খাও না?’
টেলিভিশন চ্যানেলে ঈদের নাটক দেখছিলাম। ইদানীং ট্রেন্ড দাঁড়িয়েছে, ঈদের নাটক মানেই যে কোনোভাবে হাসির ব্যাপার-স্যাপার থাকতে হবে। হাসির নাটক খারাপ কিছু না। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা অনেকেই অস্থির সময় মোকাবিলা করি। সে কারণে সহজেই হাসতে পারি না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যখন নাটক, সিনেমা দেখি, অজান্তে প্রশান্তি খুঁজি। প্রাণভরে হাসতে চাই। এ ক্ষেত্রে হাসির নাটকের ভূমিকা অনেক।
প্রশ্ন হলো, হাসির নাটক কেমন? একটি ঘটনা দেখতে দেখতেই অজান্তে আপনি হাসতে শুরু করলেন। এ ধরনের নাটক শুধু বিনোদন নয়, মস্তিষ্কে প্রশান্তি এনে দেয়। মন ভালো হয়ে যায়। ইদানীং অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাসির নাটকে কাতুকুতু দিয়ে মানুষকে হাসানোর বৃথা চেষ্টা দেখি। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অশোভন সংলাপ, অশ্রাব্য গালাগালিসর্বস্ব নাটককে ‘হাসির নাটক’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের নাটক নাকি দর্শক ‘খায়’। অবাক কাণ্ড! দেখার বিষয় কারও কারও কাছে ‘খাওয়া’র বিষয়ে পরিণত হয়েছে!
প্রতি ঈদে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দুই শতাধিক নাটক, টেলিফিল্ম প্রচার হয়। এর মধ্যে ভালো নাটক কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় উঠে আসে। এ রকম একটি নাটক দেখলাম, মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী। ৪ সদস্যের পরিবারে একমাত্র ছেলে কম বেতনের চাকরিজীবী। স্বামীর আয়-রোজগার উচ্চাভিলাষী স্ত্রীর পছন্দ নয়। কর্মক্লান্ত স্বামী স্ত্রীর দিকে বাজারের ব্যাগ এগিয়ে বলল, ইস, যা গরম পড়েছে! এক গ্লাস পানি খাওয়াও তো। বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে স্ত্রী প্রশ্ন করল, আমার সাবান-শ্যাম্পু-বডি লোশন এনেছ? স্বামীর অসহায় আত্মসমর্পণ– মাসের শেষ। আগামী মাসে বেতন পেলেই...। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠল– সামান্য সাবান-শ্যাম্পু-বডি লোশনের জন্য আমাকে আগামী মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? তোমাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে। পাশের বাসার আরশাদ সাহেব তোমার মতোই চাকরি করে। গত সপ্তাহে তারা নতুন গাড়ি কিনেছে। তার বউকে স্বর্ণের নতুন গহনা গিফট করেছে। স্বর্ণের গহনা দূরে থাক, ইমিটেশনের গহনাও কি তুমি আমাকে গিফট করেছ?
স্বামীর আবারও অসহায় আত্মসমর্পণ– আরশাদ সাহেবের সঙ্গে আমার তুলনা করবে না। সে ঘুষ খায়; আমি ঘুষ খাই না।
এবার স্ত্রী চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, কেন ঘুষ খাও না? সবাই ঘুষ খায়। তোমার খাইতে দোষ কী? কথা বলছ না কেন? কথা বল... কেমন পুরুষ তুমি, ঘুষ খাও না?
নাটক তো নাটকই। তবুও ওই অসহায় স্বামীর কথা ভাবছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সদ্য সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের রাজকীয় চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তিনিও কি পরিবারের সদস্যদের অস্বাভাবিক চাহিদা মেটাতে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন? যাই হোক, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এ ক্ষেত্রে বাপকে ছাড়েনি পুত্র। পুত্রের ‘ছাগলকাণ্ড’ ঘটার পর থেকে হাবুডুবু খাচ্ছেন বেচারা মতিউর রহমান।
না চাইতেই সন্তানকে অঢেল অর্থ, প্রাচুর্য দিয়েছিলেন মতিউর, যার কাছে টাকা তেজপাতার মতো। কোরবানির জন্য ছাগল কিনেছেন ১৫ লাখ টাকায়। সন্তান ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি– এত দামি ছাগল কেনার অর্থের উৎসের খোঁজ পড়তে পারে। ছাগলের সঙ্গে নিজের ছবিও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে– দেখো, আমরা কত ধনী! এর আগে এই দেশে আর কেউ এমন ‘কৃতিত্ব’ দেখাতে পেরেছে?
একটি গল্প মনে পড়ে গেল। ঘোড়া কিনতে গেছে এক তরুণ। ঘোড়ার মালিক জানতে চাইল, বাবু, কার টাকায় ঘোড়া কিনবেন? ছেলে গর্বের সঙ্গে বলল, বাবার টাকায়। ঘোড়ার মালিক বলল, তাহলে আপনি ঘোড়া কিনতে পারবেন। ঘোড়ার মালিক দাম চাইল। ছেলে গর্বের ভঙ্গিতে দাম মিটিয়ে দিয়ে ঘোড়া নিয়ে চলে গেল। কয়েক বছর পর ছেলে আবার ঘোড়া কিনতে হাটে গেল। সারা হাট ঘুরেও ঘোড়া কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। হঠাৎ অতীতকালের সেই ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে দেখা। ঘোড়ার মালিক জানতে চাইলেন, বাবু, এবার কার টাকায় ঘোড়া কিনবেন? ছেলে বলল, নিজের টাকায়। ঘোড়ার মালিক ভেবে নিয়ে বললেন, বুঝেছি, সে জন্যই আপনি এত ঘোরাঘুরি করছেন। আমার মনে হয় না, আপনি ঘোড়া কিনতে পারবেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কোরবানির পশু
- ঘুষ গ্রহণ