বিদ্যার পাহাড় থেকে বিদ্যাকুট
ছায়াঢাকা-পাখি ডাকা বৃক্ষ সুশোভিত তিতাস অববাহিকার একটি স্নিগ্ধ সুন্দর গ্রাম বিদ্যাকুট। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের এ গ্রামটি বহুকাল আগে থেকেই শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সম্প্রীতি-ঐতিহ্যে এক অগ্রসর জনপদ। জনশ্রুতি আছে যে তিতাস অববাহিকায় জেগে ওঠা নতুন চরাঞ্চলে বসতি গড়ে ওঠায় গ্রামটির নামকরণ হয় নবদ্বীপ। এই নবদ্বীপে ক্রমেই অনেক গুণী কৃতীর জন্ম হতে থাকে, বাড়তে থাকে বিদ্যান্বেষণে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়া বিদ্যার্থীদের সংখ্যা। বিদ্যার্থীদের গুণগত সংখ্যার স্তূপীকৃত রূপের লৌকিক নাম হয় ‘বিদ্যার পাহাড়’, যার আভিধানিক রূপ ‘বিদ্যাকুট’। এ-ও জনশ্রুতি আছে যে বিদ্যার পরিধি ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এ গ্রামটির নামকরণ হয় বিদ্যাকুট।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়ে বিদ্যার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ১৯১৩ সালে উচ্চ ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন অমর চন্দ্র ভট্টাচার্য্য। স্কুলটি ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে। তখনকার বাস্তবতায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের এই গ্রামে বেশ কয়েকটি তালুকদার ও জমিদার পরিবারের বাস ছিল। ফলে শতবর্ষের আগেই দাতব্য চিকিৎসালয়, দেওয়ানি আদালত, পোস্ট অফিস, তহশিল অফিস, কাচারি ঘর, কালীবাড়িসহ অনেক মন্দির গড়ে ওঠে। সেই সব মন্দিরে উপাসনা করে ভক্তকুলের মন যেমন পবিত্র হতো, ভেসে আসত মন্দির থেকে কীর্তনের সুর। বিপরীত ঘটনাও কি ঘটত না?
হ্যাঁ ঘটত, জীবন্ত দগ্ধদের আর্তচিৎকার ভেসে আসত যে মন্দিরটি থেকে, সেটি সতীদাহ মন্দির হিসেবে পরিচিত। গ্রামের পশ্চিম অংশে গুরুদাস হাসপাতালের পাশে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো জীর্ণ মন্দিরটিকে ধারণা করা হয় ভারতবর্ষের সর্বশেষ সতীদাহ মন্দির। হিন্দু সমাজে একসময় সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। সদ্য বিধবাকে বলপূর্বক এখানে জীবন্ত দাহ করা হতো বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে, যেন করুণ আর্তনাদ-আর্তচিৎকার দাহকারীদের কানে না পৌঁছায়। কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও সতীদাহ বরণ করত। তেমনি একজন দেওয়ান বাড়ির রাম মানিকের মাতা। ১৮৩৫ সালে তাঁকে সর্বশেষ সতী হিসেবে দাহ করা হয় এবং তাঁর নামফলক (যা মুক্তিযুদ্ধের সময় নষ্ট হয়ে যায়) খচিত এ মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়।
আধ্যাত্মিক সাধনায় সমগ্র ভারত উপমহাদেশ তথা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি যিনি অর্জন করেছিলেন, তিনি এই বিদ্যাকুটের কৃতী মা আনন্দময়ী। তাঁর পিতার নাম বিপিণ বিহারী ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম শ্রীমতী মোক্ষদা সুন্দরী। দীর্ঘদিন আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন মা আনন্দময়ীর ভক্তকুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গোটা বিশ্বে। তাঁর জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু, শ্রীমতী কমলা নেহরু, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু, বল্লভ ভাই প্যাটেল প্রমুখ মা আনন্দময়ীর ভক্ত ছিলেন।
পণ্ডিত শশীভূষণ বিদ্যালংকারের জন্মও নবদ্বীপ নামে পরিচিত বিদ্যাকুট গ্রামে। তাঁর অমর কীর্তি ‘জীবনী কোষ’ গ্রন্থ। তিনি ১৯৩৪-৪৪ খ্রিষ্টাব্দ কালের মধ্যে এই বৃহৎ জীবনী কোষ রচনা করেন। জীবনী কোষ পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক এই দুই অংশে বিভক্ত। পৌরাণিক অংশ দুই খণ্ডে এবং ঐতিহাসিক অংশ পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ‘বাল্যসখা’ ও ‘স্বাবলম্বন’ নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। তাঁর স্ত্রী বনলতা দেবী একজন কবি এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁদের কৃতী সন্তান অধ্যাপক দেবব্রত চক্রবর্তী পালি সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ করেছেন। পণ্ডিত শশীভূষণ বিদ্যালংকারকে বিদ্যাকুট গ্রামবাসী একদা সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাণী পাঠিয়েছিলেন আচার্য যদুনাথ সরকার, ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজনীতিবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি