মালয়েশিয়ার বাজার জটিল করে তুলেছে রাজনীতিকরা
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে বেশ জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ১ জুন থেকে বিদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। ফলে দেশটিতে সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিপুল সংখ্যক শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টা চালিয়েছে। এতে বিমানবন্দরে শ্রমিকদের বিশাল জটলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও বিমানের টিকিট না পাওয়ায় ১৭ হাজার কিংবা ততোধিক অভিবাসনপ্রত্যাশী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, যদিও প্রথমদিকে আমরা সংখ্যাটা ৩০ হাজারের মতো বলে শুনেছিলাম। বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) পক্ষ থেকে এ সংখ্যা চার সহস্রাধিক বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। মূলত রিক্রুটিংয়ে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের কাছেই সঠিক তথ্য থাকতে পারে। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু তাই নয়, সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না হলে তা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গাফিলতি রয়েছে। দেশটির নিয়োগকর্তাদের কাছে বাংলাদেশিদের সুনাম রয়েছে বলে তাদের চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু এই চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। এখানে কিছু অসাধু চক্র জড়িত। এ চক্রে শুধু বাংলাদেশি নয়; মালয়েশিয়ার লোকও জড়িত। এমনকি সে দেশের সরকারেরও এ চক্রে প্রভাব আছে বলে খবর বেরিয়েছে।
ক’দিন আগে আমাদের গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর বেরিয়েছে, যেখানে দেশের অনেক প্রভাবশালী, এমনকি সংসদ সদস্যের নামও উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারক অনেকে এসব অসাধু কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। এর বাইরে অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির নামও আমরা সংবাদমাধ্যমের খবরে জেনেছি।
২০১৮ সালে কিংবা এর আগে রিক্রুটিং প্রক্রিয়া শুরুর সময়েও অসাধু চক্রের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম জানা গিয়েছিল। এবারও তাদের যুক্ততার খবর পাওয়া গেছে। আমরা স্পষ্টত দেখছি, তারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। অনেক বছর ধরে সমাজে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের বলয়ে থেকে তারা এসব কাজ করছে। দুঃখজনক হলো, এত খবর বের হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ এ চক্রের তৎপরতা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় এখানে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী এজেন্সির হাতে অতিরিক্ত অর্থ তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় ক্ষেত্রে হয়রানি, জাল টিকিট কিংবা জাল ভিসা দেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার পুরো দায় এসে পড়ছে রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর। তবে আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। গ্রামের একজন দালাল থেকে শুরু করে ঢাকার অনুমোদনহীন লোক দেখানো অফিসের মালিকও এই অর্থের ভাগীদার। অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি দপ্তর এজেন্সিগুলোকে লাইসেন্স দিচ্ছে। লাইসেন্স দেওয়ার পর সেগুলো তদারক করার দায়িত্ব সরকারের। সেটি কিন্তু সরকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। অথবা দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা রাজনীতিবিদরাই এসব এজেন্সির মালিক। অনেক এজেন্সির মালিকের সঙ্গে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির সুসম্পর্ক রয়েছে। তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সরকারি অনেক কর্মকর্তাও আত্মসাৎকৃত এসব অর্থের ভাগ পান। সুনির্দিষ্টভাবে এগুলো প্রমাণ করা কঠিন। কারণ এসব অসাধু কারবার খাতাকলমে হয় না। বাংলাদেশে সুশাসন, স্বচ্ছতার যে অভাব, তাই এ ক্ষেত্রে রয়েছে। এ কারণে সরকার পুরোপুরি এই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। কেননা, রিক্রুটিং এজেন্সি সরাসরি যুক্ত থাকলেও রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে তারা কোনো লোক বিদেশে পাঠাতে পারে না।