চাল উৎপাদনের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর কেন?

বণিক বার্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম প্রকাশিত: ০২ জুন ২০২৪, ১১:৩৫

দেশের বিভিন্ন খাতে অধুনা যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো ১৫-২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে সে ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপরে। গত ৫৩ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল দৈনিক তিন কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক—কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে আট লাখ হেক্টর। তার পরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের, বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। 


বিবিএস প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, শস্য কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা ৫৩ বছর ধরে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার থেকে গড়ে অনেকটা বেশি ছিল। গত তিন বছরও তার কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। ২০২০-২১ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, ২০২১-২২ সালে ছিল ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ সালে ছিল ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। তবে কোনো কোনো সময় তার চেয়ে অনেক বেশিও অর্জন হয়েছে। যেমন ২০০৬-০৭ সালে ছিল ৭ শতাংশ এবং ২০০৯-১০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আবার কোনো কোনো সময় ছিল কম। যেমন ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে দশমিক ৮৮ ও দশমিক ৯৬ শতাংশ। তবে দীর্ঘমেয়াদে গড়ে তা সন্তোষজনক। কিন্তু ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে সম্প্রতি অনেকটা ভাটা পড়েছে। চাল হিসেবে ২০১৯-২০ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৮৬ দশমিক ৯৫ লাখ টন। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে ছিল ৩৭৬ দশমিক শূন্য ৮ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এরপর ২০২১-২২ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৯১ দশমিক ৮ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৯০ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত তিন বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার হলো দশমিক ৫২ শতাংশ। এ সময় জনসংখ্যার গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ফলে চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে বড় ধরনের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে পারেনি। সে কারণে এবং খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাতে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি তাড়িত মূল্যস্ফীতি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজিও জড়িত আছে।


চালের উৎপাদন সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রদত্ত তথ্যের বড় ফারাক। কৃষি বিভাগের তথ্যে উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখী পক্ষপাত থাকা বিচিত্র নয়। এক্ষেত্রে বিবিএস প্রদত্ত তথ্যই বেশি গ্রহণযোগ্য। তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ। কিন্তু তারা উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ ও তা প্রকাশে অনেক বিলম্ব করে থাকেন। যখন প্রকাশিত হয় তখন তা প্রধানত লাইব্রেরি ও ব্যক্তিগত আলমারিতে শোভা বর্ধন করে মাত্র। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে খাদ্যে সদয় স্বয়ম্ভরতার মাত্রা নির্ধারণ, আমদানি-রফতানির নীতিমালা প্রণয়ন এবং কর ও শুল্ক আরোপের হার নির্ধারণে তা খুব বেশি কাজে লাগে বলে মনে হয় না।


চাল উৎপাদনে সাম্প্রতিক ধীরগতির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, কৃষিজমি হ্রাস ও শস্যের বৈচিত্র্যকরণ উল্লেখযোগ্য। ফলে ধান চাষের আওতায় জমির পরিমাণ কমছে। কৃষকরা ধান চাষে পরিশ্রম করেন বেশি। খরচও বেশি। সে তুলনায় লাভ কম। সরকার ধান সংগ্রহের যে মূল্য নির্ধারণ করেন, উৎপাদন মৌসুমে কৃষকরা তার দুই-তৃতীয়াংশও অনেক সময় পান না। খামার প্রান্ত থেকে তারা ফড়িয়া ও বড় ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধির কাছে ধান বিক্রি করেন অনেক কম মূল্যে। যখন ধানের দাম বাড়ে তখন কৃষকের হাতে আর উদ্বৃত্ত থাকে না। চলে যায় চাতালের মালিকদের গুদামে। তারাই বেশি দামে চাল বিক্রি করে লাভবান হন। ঠকেন কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই। সেক্ষেত্রে সরকারের বাজার হস্তক্ষেপ বেশ অকার্যকর। তাছাড়া বৈরী আবহাওয়ায় ঘাতসহিষ্ণু জাতগুলোর সম্প্রসারণ সীমিত। ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ অপর্যাপ্ত। সম্প্রতি রাসায়নিক সারের দাম বিশ্ববাজারে প্রায় ৫২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সারের উচ্চমূল্য এখনো বহাল রয়েছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ২০২২ সালের মধ্যভাগ থেকে পরপর দুবার সারের দাম বাড়ানো হয়েছিল অভ্যন্তরীণ বাজারে। এখন বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে তা ২০২২ সালের প্রথমার্ধে প্রচলিত মূল্যসীমায় প্রত্যাবর্তন করেনি। সেচের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হয় সেচ যন্ত্রে ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর। ডিজেলে কোনো ভর্তুকি নেই। অথচ দেশে পানি সেচ প্রদানের কাজে নিয়োজিত শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ সেচযন্ত্রই এখনো ডিজেলনির্ভর। কৃষিযন্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকার ৫০ শতাংশ এবং ক্ষেত্র বিশেষে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেচ যন্ত্রের দাম টাকার অংকে অনেক বেড়ে গেছে। চলমান ভর্তুকিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি টাকা খরচ করে কৃষিযন্ত্র কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না অনেক কৃষক। এক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়ানো দরকার। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। সামনে বাজেট। তাতে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার কৃষিকে। তার প্রতিফলন দরকার বাজেট বরাদ্দের নীতিমালা। 

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও